প্রথম পর্বে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর পটভূমি তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্লাস শুরুর পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও বর্তমান অবস্থার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনাপূর্বক ‘অনলাইন ক্লাস কতটুকু কার্যকর?’ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন প্রতিবেদক। প্রথম পর্বঃ https://buetjs.com/posts/49/
নেটওয়ার্ক ইস্যুতে সাধারন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের সব প্রান্তে ইন্টারনেট সেবা এখনো সমান কার্যকর নয়। এমনকি কোনো কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে 3G সেবাও সবাই এখনো পৌঁছেনি। এছাড়াও আছে ঝড়-বৃষ্টি, কালবৈশাখী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সেবা ব্যহত হবার মতো ঘটনা।
কুড়িগ্রামে অবস্থানরত ১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী রাসেল বলছেন, "আমি প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও বিগত টার্মে অনলাইন ক্লাস করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় নি কারণ শীতকালে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয় নি বললেই চলে। এখন গরমের সাথে সাথে কালবৈশাখী চলে এসেছে, একটা করে ঝড় এর সাথে ২০ ঘণ্টা ৩০ ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। যেহেতু অনলাইন ক্লাসের প্রায় প্রতিটি বিষয় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগের উপর নির্ভরশীল তাই এমন পরিস্থিতিতে সবকিছু চালিয়ে যাওয়াই দুরূহ হয়ে পড়েছে আমাদের জন্য”।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, অনেক শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের এইসব অসুবিধায় অনমনীয়। ক্লাস বা ক্লাসটেস্ট চলাকালীন কোনো শিক্ষার্থীর বিদ্যুৎ/ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে শিক্ষকদের অনুরোধ করেও সাবমিশনের সময় বাড়ানো যায় না। অনেকেরই ল্যাবের তাৎক্ষণিক এসেসমেন্ট এবং সিটি মিস হয়ে যাচ্ছে। ক্লাসের ক্ষেত্রে যথাসময়ে কানেকশন প্রব্লেম দেখা দিলে এটেন্ডেন্স দিতেও আপত্তি জানান অনেক শিক্ষক।
এই প্রসঙ্গে জনৈক শিক্ষক বলেন, “ দেশের সব জায়গায় ইন্টারনেট সেবা সমান ভাবে পাওয়া যায় না। এই কারনে অনেক শিক্ষার্থী সিটি কিংবা এসাইনমেন্ট সাবমিট করতে পারছে না। এমনকি, অনেকে সময়মত পরীক্ষায়ও অংশ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের, যারা ঠিকমত ইন্টারনেট কিংবা বিদ্যুৎ সেবা পাচ্ছে না, তাদের সঙ্গে একরকম বৈষম্য করা হচ্ছে”।
অবশ্য এই ব্যাপারে প্রশাসন তথা স্বয়ং মাননীয় উপাচার্য মহোদয় সকল শিক্ষার্থীর নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎজনিত সমস্যা আবেদনের প্রেক্ষিতে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিগত ৪ এপ্রিল, মাননীয় উপাচার্য, সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ ও বিভিন্ন বিভাগের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভদের সঙ্গে এক বৈঠকে মাননীয় উপাচার্য মহোদয় বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক সমস্যা সমাধানে কিছু উপায় তুলে ধরেন। যেমনঃ
• যেসকল এলাকায় কানেকটিভিটি নেই, সেখানে টাওয়ার বসানোর ব্যবস্থা হবে। যেসকল এলাকায় নেটওয়ার্ক দুর্বল সেখানে বুস্টার বসানোর ব্যবস্থা হবে। তাই যাদের নেটওয়ার্ক জনিত সমস্যা আছে তাদের DSW স্যার বরাবর ই-মেইল করতে হবে।
• গ্রামাঞ্চলে, লম্বা সময় ধরে কারেন্ট থাকে না থাকলে সেসব এলাকায় একটা সময় পর মোবাইল অপারেটর এর টাওয়ার গুলোও বন্ধ হয়ে যায়। সেই অবস্থায় একজন শিক্ষার্থী শুধু ইন্টারনেট না, মোবাইল সেবা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই সকল সমস্যায় শুধুমাত্র DSW স্যার বরাবর ই-মেইল করলে বিষয়টির সমাধানে তাঁরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
তবে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের এসব উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতি এখন পর্যন্ত কোথাও বাস্তবায়িত হয়েছে বলে জানা যায় নি।
এসব সমস্যার সমাধান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে যথেষ্ট পরিমাণ সাবমিশন টাইম, বিকল্প সাবমিশনের ব্যবস্থা এবং কেউ সম্পূর্ণ অপরাগ হলে তার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুযোগের জন্য সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত চান শিক্ষার্থীরা। এর সমাধান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে-
• কোর্স শিক্ষক ক্লাশ টেস্ট/কুইজ ইত্যাদি সাবমিশন এর জন্য আলাদাভাবে একটি যৌক্তিক সময় প্রদান করিবেন। সেশনাল কোর্স এর ক্ষেত্রে কোর্স শিক্ষক ল্যাব রিপোর্ট সাবমিশনের জন্য একটি যৌক্তিক সময় প্রদান করিবেন। শিক্ষকগণ সকল লেকচারের প্রি-রেকর্ডিং অথবা ক্লাশ এর রেকর্ডিং প্রদান করিবেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানগণ ল্যাব কোর্সের জন্য হাই রেজুলেশন ভিডিও ধারণের ব্যবস্থা নিবেন। এই বিষয়গুলি সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানগণ বিইউজিএস এর মাধ্যমে সকল শিক্ষককে পালন করার ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করিবেন।
• Class Test/Quiz, Assignment, Viva, Presentation এর সংখ্যা n ক্রেডিট আওয়ার কোর্সের জন্য ন্যুনতম (n+১) হইবে যাহার মধ্যে সবচাইতে ভাল n সংখ্যক মার্কস নিয়া মোট মার্কস হিসাব করা হইবে। তবে Class Test/Quiz, Assignment, Viva, Presentation ইত্যাদির সংখ্যাবিন্যাস কোর্স শিক্ষক নিজেই নির্ধারণ করিবেন এবং কোর্স শিক্ষক চাইলে (n+১) এর বেশি Class Test/Quiz, Assignment, Viva, Presentation ইত্যাদি নিতে পারিবেন।
অর্থাৎ, বুয়েট প্রশাসন সাবমিশন সংক্রান্ত জটিলতার সমাধান পুরোটুকুই সম্মানিত শিক্ষকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। সুতরাং শিক্ষার্থীদের অসুবিধাগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে যেকোনো শিক্ষকেরই এক্তিয়ার আছে নিজ উদ্যোগে ক্লাস টেস্ট ও সাবমিশন সংক্রান্ত জটিলতা সমাধান করা।
ইতোমধ্যেই অনেক কোর্স শিক্ষকই নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান করে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের একজন শিক্ষার্থী জানান, "আমাদের শিক্ষকরা যথেষ্ট স্টুডেন্ট-ফ্রেন্ডলি। আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষকদের অনুরোধ করে সিটি বা এসাইনমেনন্ট এর রুটিন আমাদের সুবিধামতো সময়ে ফেলতে পারছি।অনলাইন ইভালুয়েশন এর ব্যাপারেও টিচাররদের পক্ষ থেকে শিথিলতা দেখা গিয়েছে। সুতরাং আমার ডিপার্টমেন্ট এর কার্যক্রম নিয়ে আমি সন্তুষ্ট”।
তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের অনেক শিক্ষকই সহযোগিতামূলক আচরণ করছেন। কালবৈশাখীর ঝড়ের কারণে বেশ কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকায় আমাদের অনুরোধে কেউ কেউ এটেনডেন্স কন্সিডার করেছেন।"
সেই সঙ্গে আছে মুদ্রার অপর পিঠ। গুরুতর অভিযোগ এসেছে, শিক্ষার্থীদের যেকোনো অসুস্থতায়ও কিছু কিছু শিক্ষক ছাড় দিতে নারাজ। এমনকি, অভিযোগ এসেছে, কোভিড আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের ও যথাসময়ে এসাইনমেন্ট জমা দেবার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে!
এই ব্যাপারে কোভিড পজিটিভ ১৬ ব্যাচের একজন অনুযোগ জানান, "আমার খালা ক্যান্সারের পেশেন্ট এবং গত টার্মে তিনি করোনা টেস্টে পজিটিভ আসার পরে আমি তার সাথে ছিলাম। তিন সপ্তাহ পরে আমারো পজিটিভ আসে। এই সময়ে আমার বেশ কিছু ল্যাব রিপোর্ট বাকি থেকে যায়। টিচারদের এব্যাপারে ক্লাসে জানানোর পরে, মেইল করি এবং পরে ফোনেও কথা বলি। ল্যাবের ম্যাম কোনো আশ্বাস না দিয়ে সিনিয়র একজন স্যারের সাথে কথা বলতে বলেন। তিনিও অভিযোগ করেন যে অন্য কারো সমস্যা না হলে আমারই কেন সমস্যা হচ্ছে। তিনি বিবেচনা করবেন এমন কথা দিতে পারবেন না বলেন। শুধুমাত্র S/F টার্ম হওয়াতেই আমি নিজেকে স্বান্তনা দিতে পারছিলাম। গ্রেডেড টার্ম হলে অসুস্থ অবস্থায় এমন তিরস্কার এবং মানসিক চাপ নেওয়া অসম্ভব হয়ে যেতো”।
মহামারির এই সময়টায় শুধু যে শিক্ষার্থীরা ঝুঁকির মুখে আছে তাই নয়, সেই সঙ্গে ঝুঁকিতে আছেন মাননীয় শিক্ষকবৃন্দ ও তাদের পরিবার। তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের প্রফেসর ড.কাজী মজিবর রহমান স্যার করোনা আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ এক সপ্তাহ অসুস্থ থাকার পর বিগত ১৬ এপ্রিল তারিখে তাকে আইসিইউ তে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়াও, একই ডিপার্টমেন্টের সদ্য অবসর প্রাপ্ত তাইফুর স্যার বিগত এপ্রিল ১১ তারিখে করোনা আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
সঙ্গত কারনেই কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠকে কোনো শিক্ষার্থী কোভিড আক্রান্ত হলে কি ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা চাওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, গত ১৮ এপ্রিল বুয়েট ওয়েবসাইটে কোভিড আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করে নোটিশ জারি করা হয়। উক্ত নোটিশে বলা হয়ঃ
• শিক্ষার্থীদের অথবা শিক্ষার্থীদের পরিবারের (মা/বাবা/ভাই/বোন) কেউ করোনায় আক্রান্ত হইলে কোভিড-১৯ সনদ অথবা প্রেসক্রিপশন দাখিল করিলে ১৪ দিনের জন্য একাডেমিক কার্যক্রম হইতে ছাড়/ছুটি দেওয়া হইবে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী উক্ত সময়ে অনুষ্ঠিত Class Test/ Viva/Presentation -এ অংশগ্রহণ না করিতে পারিলে কোর্স শিক্ষক সেইগুলি পরে গ্রহণের ব্যবস্থা নিবেন। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর জন্য ছুটিকালীন সময় বাদ দিয়া ক্লাশে অংশগ্রহণ এবং উপস্থিতির শতকরা হার নির্ণয় করিতে হইবে।
ক্রমবর্ধমান এই মহামারির সময়টায় দিনের পর দিন পরিস্থতি স্বাভাবিক হবার আশায় বসে থাকার চেয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাই হয়তো উৎকৃষ্ট বিকল্প। সাধারন শিক্ষার্থীরাও অনলাইনে ক্লাস করতে চায়। এই কঠিন সময়ে যেখানে সকলের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে, সেখানে সম্মানিত শিক্ষকদের সামান্য সহানুভূতি ও সহযোগিতাই পারে শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তি অনেকাংশে বৃদ্ধি করতে। সেই সঙ্গে, কার্যকর ভাবে অনলাইন ক্লাস করার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণের আশা করছে সাধারন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ- সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই মহামারি মোকাবেলা করে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যাবে, এমনটাই আশা করছে সাধারন শিক্ষার্থীরা।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!