মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফেরি সেফটি অ্যাসোসিয়েশন (WFSA) বিশ্বজুড়ে নিরাপদ ফেরির নকশা এবং পরিচালনায় কাজ করে। ফেরি দুর্ঘটনা প্রতিরোধ এবং নিরাপদ ফেরির প্রাপ্যতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই সংস্থা প্রতিবছর একটি আন্তর্জাতিক ফেরি ডিজাইন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।
এবারে প্রতিযোগিতার ১১তম আসরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবায়ের ইবনে আওয়ালের তত্ত্বাবধানে ৭ সদস্যের Team Black Pearl অংশগ্রহণ করে। উদ্ভাবনী নকশা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে তারা দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে, যা বুয়েট এবং বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবজনক অর্জন। প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে ইন্দোনেশিয়ার Sepuluh Nopember Institute of Technology (ITS) এবং তৃতীয় হয় Universitas Indonesia। বিজয়ী দলগুলো যথাক্রমে ৫,০০০, ৩,০০০ ও ১,০০০ ডলার পুরস্কার পায়। গত ৯ম এবং ১০ম আসরেও বুয়েটের দল যথাক্রমে তৃতীয় স্থান ও অনারেবল মেনশন অর্জন করেছিল- যা তাদের ধারাবাহিক সাফল্যেরই প্রমাণ। প্রতিবারের মতো এবারও নির্দিষ্ট রুটের জন্য নিরাপদ ও পরিবেশ বান্ধব নৌযানের নকশা তৈরির প্রতিযোগিতা হয়। এ বছর অংশগ্রহণকারীদের চ্যালেঞ্জ ছিল নাইজেরিয়ার নাইজার নদীতে Ndoni-Idah (১৯০ কি.মি.) ঘাটের মধ্যে চলাচল উপযোগী একটি RoPax ফেরির ডিজাইন করা যা ১৫০-২০০ প্যাসেঞ্জার, ১৫-২০টি চার চাকার গাড়ি ও একইসাথে কৃষিপণ্য পরিবহন করতে সক্ষম। নদীর ভুতাত্ত্বিক অবস্থা যেমন- সরু চ্যানেল, সীমিত নাব্যতা, বিপদজনক ছোট পাথর, ভাসমান কাঠ ও কচুরিপানার উপস্থিতির পাশাপাশি জুড়ে দেওয়া হয় বিভিন্ন শর্ত যেমন: কোনো এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম ব্যবহার করা যাবে না, প্রপালশন সিস্টেমটি পরিবেশবান্ধব হতে হবে ইত্যাদি, ডিজাইন প্রক্রিয়াটাকে আরো চ্যালেন্জিং করে তুলেছিলো। Team Black Pearl এই চ্যালেঞ্জগুলো দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেছে।
টিম ক্যাপ্টেন মোঃ আব্দুল কাদের বলেন, “আমরা সমস্যা চিহ্নিত করে উদ্ভাবনী ও কার্যকরী সমাধান খুঁজেছি। উদাহরণস্বরূপ, কচুরিপনা, ভাসমান কাঠ ও পাথর থেকে ফেরিকে রক্ষা করতে আধুনিক টিলটেবল প্রপেলারে অতিরিক্ত প্রটেকশনের ব্যবস্থা করেছি এবং জাহাজের কাঠামো (Hull) শক্তিশালী করেছি। ফেরিটিকে পরিবেশবান্ধব করতে ইলেকট্রিক প্রপালশন সিস্টেমের সাথে হাইড্রকাইনেটিক টার্বাইন যুক্ত করেছি, যা পানির স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। সাধারণ সোলার প্যানেলের পরিবর্তে পেরোভস্কাইট সোলার সেল ব্যবহার করেছি, যা বেশি কার্যকর। এছাড়া প্রচলিত এয়ার কন্ডিশনিংয়ের বদলে আমরা ডিজাইন করেছি nature-inspired ventilation system, যা জ্বালানী সাশ্রয় করে কার্যকরী সমাধান দিতে সক্ষম। আমার বিশ্বাস, আমাদের এই উদ্ভাবনী চিন্তাধারা আমাদের অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায় এগিয়ে রেখেছে।”
দলের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইমন ঘোষ প্রান্ত বলেন, “ফেরিতে নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছি। ফায়ার সেফটি সিস্টেমে ফায়ার স্পিঙ্কলার, এলার্ম ও অটোমেটেড CO2 সিস্টেম যুক্ত করেছি। এছাড়া একটি কাস্টম ডিজাইনড ফায়ার এসকেপ প্লানও তৈরি করেছি, যা ডিজাইনকে একটি বিশেষত্ব দিয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা ৫৮টি বিভিন্ন ডেমেজ কন্ডিশন বিবেচনা করেছি এবং সিকিপিং এনালাইসিসের মাধ্যমে যাত্রাকালীন স্বাচ্ছন্দ্যও নিশ্চিত করেছি।” দলের অপর ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাইয়েদ সাদিক সিদ্দিকী বলেন, “প্রোপালশন পাওয়ার মিনিমাম রাখার লক্ষ্যে হালের আকৃতির অপটিমাইজেশনের জন্য আমরা Computational Fluid Dynamics (CFD) ব্যবহার করেছি। এছাড়া, প্রোপেলারের CFD বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করেছি যেন তা কার্যকরী হয়।” দলের আরেকজন ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম বলেন, “পুরো কনসেপ্ট ডিজাইনটার একটা 3D মডেলিং করে বিচারকদের সামনে পেশ করা হয়, যেটি আমাদেরকে যেমন ভিজুয়ালাইজেশনে সহায়তা করেছে তেমনি ডিজাইনটার বিচার বিশ্লেষনে এগিয়ে থাকতেও সহায়তা করেছে।” সামিউন মুনতাছির সিয়াম, দলের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী বলেন, “দলের মিলিত প্রচেষ্টাই এই ফলাফল এনে দিয়েছে। দলের সকল সদস্য তাদের সর্বোচ্চটা দেয়াতেই বুয়েট সেরা সাফল্য অর্জন করেছে।”
দলের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ সাফায়েত হোসেন শিশির বলেন, “আমি ফেরি ডিজাইনের জেনারেল অ্যারেঞ্জমেন্ট (GA) এবং আউটবোর্ডের মূল দায়িত্বে ছিলাম। ফেরি ডিজাইন একটি সময় সাপেক্ষ বিষয় - প্রায় ৬ মাস যাবৎ আমরা এই ডিজাইনটির উপরে কাজ করেছি । ডিজাইন স্পাইরালকে কেন্দ্র করে প্রতিটি ধাপে ধাপে ডিজাইনের পরিবর্তন করতে হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় শর্তাবলী (Terms of Reference) সঠিকভাবে ডিজাইনের মধ্যে তুলে ধরতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ডিজাইনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে যেতে হয়েছে। তাছাড়া,আন্তর্জাতিক বিধিবিধান (IMO,SOLAS) মেনে ডিজাইন সম্পন্ন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। এটি ভবিষ্যতে আমাকে আরও ভালো ডিজাইনের কাজ করতে উৎসাহ দেবে।” দলের আরেক ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী আবু রাসেল বলেন, “ফেরির হাল ডিজাইন এবং 3D ডিজাইনার হিসেবে কাজ করা আমার জন্য এক অনন্য ও চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা ছিল, যেখানে Architectural Aesthetics ও Effectiveness এর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই দুই দিক মাথায় রেখে কাজ করতে গিয়ে আমি শিখেছি কীভাবে সৃজনশীলতা ও প্রকৌশল একসাথে মিলিত হয়ে বাস্তব সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমি আশা করি, আমার এই অভিজ্ঞতা ও সাফল্য অন্যদেরও তাদের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে নতুন কিছু সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করবে।”
দলের ফ্যাকালটি এডভাইজার অধ্যাপক ডঃ জোবায়ের ইবনে আওয়াল এর মতে, “বুয়েটের ছাত্ররা প্রযুক্তিগত এই দক্ষতা ও উদ্ভাবনী চিন্তাধারা বিকাশ ঘটিয়ে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতার মাধ্যমে একটি অত্যন্ত কঠিন প্রতিযোগিতায় সাফল্য নিয়ে এসেছে। তারা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। এই সাফল্য এটা প্রতীয়মান করে যে বুয়েটের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগ উদ্ভাবনী, প্রতিভাবান এবং দক্ষতা সম্পন্ন তরুণ প্রকৌশলী তৈরি করছে যারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক জাহাজ শিল্প (Modern Ship Building and Recycling) এর অভাবনীয় বিকাশ ঘটানোর সক্ষমতা রাখে এবং একই সাথে ব্ল ইকোনমি (Blue Economy), ওশান ইঞ্জিনিয়ারিং (Ocean Engineering) এবং অফশোর ইঞ্জিনিয়ারিং (Offshore Engineering) সেক্টরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।”
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!