দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ, শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ডিভাইসের অভাব, আর্থিক সমস্যা ও কোভিড-১৯ এর করাল থাবার মধ্যেই বিগত প্রায় একবছর ধরে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (BUET)।
শুরুতেই, পুরো শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে স্থানান্তর করা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার ছিলো। কিন্তু, শিক্ষার্থীদের যাবতীয় আর্থিক ও কারিগরী সুবিধা দেওয়া এবং তাদের অসুবিধাগুলির প্রতি সদয় দৃষ্টি রাখার প্রতিশ্রতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ফলশ্রুতিতে, কোভিড ১৯ এর লাগামছাড়া সংক্রমনের সাথে ক্রমবর্ধমান সেশনজটের কথা ভেবেই বিগত বছরের আগস্ট মাসের ২২ তারিখ থেকে পুরোদমে শুরু হয় অনলাইন ক্লাস।
অনলাইন ক্লাস শুরুর আগে করা একটি সার্ভেতে দেখা যায় ৫% শিক্ষার্থী বলেছিলো তাদের কাছে অনলাইন ক্লাস করার জন্য ইকুইপড ডিভাইস (ল্যাপটপ/স্মার্টফোন) নেই। প্রায় ৬২.৬% (৯০৫ জন) বলেছে তাদের ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে ক্লাস করার সঙ্গতি ছিলো না।
বুয়েট প্রশাসন এই সমস্যাগুলো সমাধানে শিক্ষার্থীদের এককালীন সফট লোন (০% ইন্টারেস্টে ৩০০০০ টাকা পর্যন্ত) দিয়ে ডিভাইস কিনতে সাহায্য করা হয়। ইন্টারনেট সুবিধার জন্য মাসিক ভাতা ( ৫০০ টাকা) দেওয়া এবং পরবর্তীতে ফ্রি সিম সরবরাহ করা হয়।
এছাড়াও, করোনা মহামারি শুরু হবার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পুরকৌশল, যন্ত্রকৌশল সহ বিভিন্ন বিভাগের সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ নিজ উদ্যোগে ফান্ড গঠন করে দরিদ্র ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেছেন।
কিন্তু, ক্লাস শুরু হবার পরবর্তী সময়গুলোতে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের প্রতি কতটুকু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পেরেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? হাতেকলমে শেখার সুযোগ না পেয়ে অনলাইনে প্রকৌশলবিদ্যার মত প্রায়োগিক বিদ্যা শেখা কতটুকু কার্যকর? শিক্ষকরাই বা কেমন মানিয়ে নিতে পারছেন বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তির সাথে? প্রশ্নগুলোর জবাব জানতে দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই অনলাইন ক্লাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিবেদক কয়েকজন শিক্ষক ওবিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।
১৮ ব্যাচের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী অজয় কুমার সরকার অনলাইন ক্লাস সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলেন, "অনলাইন ক্লাসের কার্যকারিতা যদি তুলনা করি তাহলে সেটা কখনোই অফলাইন এর মতো হবে না। কারণ হিসেবে যদি বলি আমাদের শিক্ষকদের দিক থেকে তাদের কিছু অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ।নিজেদের দিক থেকে যদি চিন্তা করি আমরা খুব একটা মনোযোগ ধরে রাখতে পারি না। দেখা যাচ্ছে একটা ক্লাসের পরেই আরেকটা ক্লাস। মাঝে শুধু জয়েন করার টাইমটাই একটু যা ব্রেক। এছাড়া শারীরিক সমস্যাও দেখা যাচ্ছে আমার। ক্রমাগত মাথা ব্যাথা করতেই থাকে” ।
একই প্রসঙ্গে প্রতিবেদক জনৈক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন। উক্ত শিক্ষকের মতে, “অনলাইন ক্লাসে আসলে ‘আই কন্টাক্ট’ থাকে না। এতে শিক্ষার্থীরা কতটুকু বুঝতে পারছে সে ব্যাপারে শিক্ষকরাও জানতে পারেন না। আসলে, ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে যদি শুধু একমুখী যোগাযোগ বা One Way Communication থাকে, তবে তা কখনোই শিক্ষার জন্য কার্যকরী উপায় নয়“।
টানা অনলাইন ক্লাসের ফলে সৃষ্ট শারীরিক ও মানসিক চাপ সম্পর্কে ১৭ ব্যাচের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, "চোখের উপর মারাত্মক চাপ পড়ে। ল্যাপটপ স্ক্রিন থেকে অন্যদিকে তাকালে বেশ কিছুক্ষণ ঝাপসা দেখি। মাথাব্যথা হয় প্রচুর। এটা বাদ দিলেও, শিক্ষকরা শুধু স্লাইড পড়িয়ে যাচ্ছেন যা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটির জন্যে লজ্জাজনক। এই বিষয়গুলোতে স্যারদের হয়তো দোষ নেই। কারন, একই জিনিস অফলাইনে পড়ালে তারা হয়তো আরো ভালো ইন্টারেক্টিভ ওয়েতে পড়াতে পারতেন”।
এই প্রসঙ্গে জনৈক শিক্ষক বলেন, “ডিভাইস ব্যবহারের নিয়ম হচ্ছে টানা ২০ মিনিট ব্যবহারের পর সামান্য বিরতি দিয়ে আবার ব্যবহার করা। অথচ, অনলাইন ক্লাসগুলোয় টানা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিভাইসগুলো ব্যবহার করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর চাপ পড়ছে”।
এবার, দেখা যাক কার্যকর ভাবে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে বুয়েট প্রশাসন কি কি পদক্ষেপ নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল । বিগত ১৮-০৮-২০২০ তারিখে বুয়েট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত নোটিশ অনুসারেঃ
• একটি পরিপূর্ণ Learning Management System (LMS) ব্যবস্থা করা হবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য। কার্যকর ভাবে LMS ব্যবহার করতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্যে আলাদা ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
• প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের জন্যে একটি পূর্ণাঙ্গ সুবিধা সমৃদ্ধ স্মার্ট ক্লাসরুম ও ডিজিটাল ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা থাকবে। স্মার্ট ক্লাসরুমগুলোয় কম্পিউটার, মনিটর, উচ্চমানের অডিও ও ভিডিও রেকর্ড করার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ভিডিও এডিটিং সফটওয়্যার প্রভৃতি সরবরাহ করা হবে।
• প্রত্যেক শিক্ষককে অনলাইনে লেকচার আপলোড করার জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি সুবিধা যেমন ল্যাপটপ, ডিজিটাল রাইটিং ট্যাবলেট, মাইক্রোফোন ও হেডফোন সরবরাহ করা হবে।
অথচ দুঃখের বিষয়, উক্ত নোটিশের সুদীর্ঘ নয় মাস পার হয়ে গেলেও এখনো অনেক শিক্ষকই এসব কারিগরি সুবিধা পান নি। মাইক্রোসফট টিমস ও জুম সহযোগে যে LMS গঠন করা হয়েছে, সেই সব সফটওয়্যার ব্যবহার করতে এখনো বেশিরভাগ শিক্ষক সাবলীল নন। এই প্রসঙ্গে একজন শিক্ষক বলেন, “ সাধারন অফলাইন ক্লাসগুলোয় বোর্ডে লিখে যতটা বিস্তারিত ভাবে বোঝানো যেত, অনলাইন ক্লাস গুলোয় তেমনটা পারা যায় না। স্লাইড আর হোয়াইট বোর্ডের মাঝে বারবার সুইচ করার ফুরসতে শিক্ষার্থীদের ঠিকমত বোঝানো কষ্টকর । এছাড়া অনেক শিক্ষকই জুমে ক্লাস নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনন৷ ইদানিং জুমে মিটিং এ প্রচুর টেকনিক্যাল ডিফিকাল্টিজ হচ্ছে”।
সেই সঙ্গে স্মার্ট ক্লাসরুম ও ডিজিটাল ল্যাবরেটরি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি আজ পর্যন্ত আশার আলো দেখেনি। এখনো সকল শিক্ষককে রাইটিং ট্যাবলেট, হেডফোন বা মাইক্রোফোন সরবরাহ করা হয়নি। যারই ফলশ্রুতি শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি সেই সঙ্গে কার্যকর অনলাইন ক্লাস পরিচালনায় ব্যর্থতা।
বাকি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনেকটা ব্যতিক্রম হিসেবেই, বিগত টার্ম অগাস্ট ২০২০ থেকেই ল্যাবরেটরি ক্লাসগুলো অনলাইনে পরিচালনা করছে বুয়েট প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আছে যে শিক্ষকদের যথাযথ অবকাঠামোগত সুবিধা নেই অথবা তারা ব্যবহার করছেন না। যেখানে স্নাতক পর্যায়ে ল্যাবরেটরি ক্লাস গুলো শিক্ষাক্রমে রাখার মূল উদ্দেশ্যই ছিলো শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে প্রায়োগিক জিনিস শেখানো, সেখানে নামমাত্র 'ক্রেডিট আওয়ার' এর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অনলাইনে ল্যাব ক্লাস করার কার্যকারিতা কতটুকু?
এই প্রসঙ্গে ১৮ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী বলেন, "আমাদের এই টার্ম এ যে দুইটা ল্যাব আছে তা আসলে কোনভাবেই অনলাইনে করা সম্ভব না। ফুয়েল টেস্টিং এর মত ল্যাব আমরা শুধু অনলাইনে দেখে শিখে ফেলছি তেমন কিন্তু না। শুধু ল্যাবরিপোর্ট লিখেই শেষ করে দিচ্ছি। অফলাইনে সেই ল্যাব আমরা কবে করবো তার ও কোন ঠিকঠিকানা নেই। প্রায়োগিক জিনিসগুলি শুধু ডেমন্স্ট্রেশনের মাধম্যে শিখে আমাদের কোনো উপকার হচ্ছে না”।
এদিকে প্রতি টার্মের শেষে হওয়া ফাইনাল এক্সাম বা টার্ম ফাইনাল (মূল গ্রেডের ৭০%) যাতে অফলাইনে নেয়া হয় সেই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে প্রশাসন। অথচ, ল্যাবগুলোর ক্ষেত্রে ফাইনাল পরীক্ষার সমতুল্য ফাইনাল ল্যাব টেস্ট এবং কুইজগুলো অনলাইনে নেওয়া হবে বলে বলা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা উক্ত ল্যাব এক্সাম গুলো অফলাইনে দেবার জন্য অনুরোধ করলেও প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অনেকটাই অনড়। থিওরি কোর্সগুলোর ফাইনাল এক্সাম অফলাইনে নিয়ে ল্যাব কোর্সগুলোর ফাইনাল এক্সাম অনলাইনে নেওয়া কতটুকু যৌক্তিক ও কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে শিক্ষার্থীরা।
সম্প্রতি, বিভিন্ন ব্যাচে অনানুষ্ঠানিক ভাবে চালানো এক জরিপে দেখা যায়, মোট শিক্ষার্থীদের প্রায় ৭৯.২% অনলাইন ক্লাসের কারনে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। একই জরিপে প্রায় ৬৭.৪% শিক্ষার্থী অনলাইনে হওয়া ল্যাবরেটরি ক্লাস গুলো নন ক্রেডিট কোর্স হিসেবে অফলাইনে করতে চায়। শিক্ষার্থীদের আশা কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে প্রশাসন ল্যাবরেটরিতে গিয়ে ননক্রেডিট হিসেবে হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখার জন্য নির্ধারিত সময় রাখবে।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!