গত রোববার থেকে ফুটবল বিশ্বের চাঞ্চল্যকর বিষয় ইউরোপীয়ান সুপার লিগ (ESL)। রোববার সুপার লীগ কমিটি থেকে দেওয়া একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “Twelve of Europe’s leading football clubs have today come together to announce they have agreed to establish a new mid-week competition, the Super League, governed by its Founding Clubs.”
এই বিবৃতিকে সমর্থন জানিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের চেয়ারম্যান ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ, জুভেন্টাস চেয়ারম্যান আন্দ্রেয়া আগনেল্লি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কো-চেয়ারম্যান জোয়েল গ্লেজার নিজেরা বিবৃতি দিয়েছে।
যে ১২ টি ফুটবল ক্লাব এই ইউরোপীয়ান সুপার লীগ আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেগুলো হলো- ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ম্যানচেস্টার সিটি, টটেনহাম, আর্সেনাল, চেলসি ও লিভারপুল; স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ; ইতালির এসি মিলান, ইন্টার মিলান ও জুভেন্টাস। সুপার লীগ কমিটির পরিকল্পনা হলো আরো তিনটি ক্লাবকে তাদের সাথে ফাউন্ডিং ক্লাব হিসেবে নিয়ে আসা। প্রথমে পিএসজি, বায়ার্ন মিউনিখ ও বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডকে ঐ তিনটি ক্লাব হতে পারে ধারণা করা হলেও গতকাল তিনটি ক্লাবই নিজস্ব বিবৃতিতে পরিষ্কার করেছে যে তারা এই ইউরোপীয়ান সুপার লীগের পরিকল্পনাকে সমর্থন করছে না। তাই এখনো ঐ তিনটি ক্লাব কে হতে পারে তা নিয়ে একটি ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
সুপার লীগের ফাউন্ডিং ক্লাবগুলো একটি যৌথ বিবৃতিতে এটাও ঘোষণা করে যে ইউরোপীয়ান সুপার লীগ শুরুর সাথে সাথেই ক্লাব গুলোর নারী দল নিয়ে একটি উইমেনস’ লীগও শুরু হবে, যদিও উক্ত লীগ সম্পর্কে এখনো পরিষ্কারভাবে কিছু বলা হয়নি। লিভারপুল ফাউন্ডিং ক্লাব হলেও তাদের নারী দল বর্তমানে ইংলিশ ফুটবলের ২য় বিভাগে খেলছে, যেখানে গত পাঁচবারের উইমেনস’ চ্যাম্পিয়নস লীগের চ্যাম্পিয়ন অলিম্পিক লিওঁ ফাউন্ডিং মেম্বারদের মধ্যে নেই, তাই এই পুরো ব্যাপারটা এখনো ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে আছে।
সুপার লীগ কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক লীগটি হবে আগস্ট থেকে শুরু হয়ে পুরো সিজনব্যাপী। লীগে অংশগ্রহণ করবে ২০ টি দল। এর মধ্যে ১৫ টি ফাউন্ডিং ক্লাব নিজেদের ডোমেস্টিক লীগে পজিশন যাই হোক না কেন, প্রতি সিজনেই অংশগ্রহণ করবে। অবশিষ্ট পাঁচটি ক্লাবকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। যদিও বাকি পাঁচটি ক্লাব কিভাবে নির্ধারণ করা হবে তা নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়নি। প্রতি গ্রুপে ১০ টি করে ২ টি গ্রুপে ভাগ হয়ে টিমগুলো একে অপরের বিপক্ষে হোম ও অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে ২ টি করে ম্যাচ খেলবে। এরপর উভয় গ্রুপ থেকে টপ থ্রি ক্লাব সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালের জন্য কোয়ালিফাই করবে। দুই গ্রুপেরই ৪ ও ৫ নাম্বার দল নিজেদের মধ্যে হোম অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে প্লে অফ খেলে কোয়ার্টার ফাইনালের জন্য দুটি ক্লাব কোয়ালিফাই করবে। এবার এই ৮ দল নিয়ে শুরু হবে নকআউট রাউন্ড। হোম ও অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে দুই লেগের কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনাল হয়ে ফাইনালে উঠবে যেকোন দুইটি দল। এক লেগের ফাইনাল হবে কোন এক নিউট্রাল গ্রাউন্ডে।
সুপার লীগ কমিটির এই পরিকল্পনা জানানোর পর উয়েফা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। উয়েফার পাশাপাশি ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন, প্রিমিয়ার লীগ, রয়েল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন, লা লীগা, ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশন, সিরি’আ এই টুর্নামেন্টের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে। তারা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন যে অংশগ্রহণকারী ক্লাব গুলোর বিরুদ্ধে তারা লিগ্যাল একশন নিবে এবং প্রয়োজন হলে ক্লাবগুলোকে ডোমেস্টিক লীগ থেকেও ব্যান করা হবে। ফিফা উয়েফা ও ডমেস্টিক লীগ কমিটিগুলোর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে। প্রয়োজন হলে ঐ টুর্নামেন্টে খেলা প্লেয়ারদের ভবিষ্যতে ফিফা ও উয়েফার টুর্নামেন্টে ন্যাশনাল টিম থেকেও ব্যান দেওয়া হতে পারে বলে জানানো হয়েছে।
এরই মধ্যে গতকাল উয়েফা তাদের প্রধান কম্পিটিশন চ্যাম্পিয়নস লীগের নতুন ফরম্যাট ঘোষণা করেছে। এই ফরম্যাট অনুযায়ী ৩২ দলের ৮ টি গ্রুপের ফরম্যাটের বদলে ৩৬ টি দল নিয়ে সুইস মডেল ফরম্যাটের লীগ হবে। প্রত্যেক ক্লাব ১০ টি করে ম্যাচ খেলবে; পাঁচটি হোম ও পাঁচটি হবে অ্যাওয়ে ম্যাচ। ১০ ম্যাচ শেষে টপ আটটা ক্লাব সরাসরি রাউন্ড অফ সিক্সটিনে খেলার সুযোগ পাবে, পরের ১৬ টি ক্লাব নিজেদের মধ্যে প্লে অফ খেলবে এবং প্লে অফে জেতা ৮ টি দল রাউন্ড অফ সিক্সটিনে খেলার সুযোগ পাবে। যদিও গতকাল ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ এল চিরিঙ্গিতো টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই সুইস মডেল ফরম্যাটের বিরোধিতা করেন।
যেকারনে ১৯৯২ সালে ইউরোপীয়ান কাপ এর বদলে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ শুরু হয়েছিলো কিংবা প্রিমিয়ার লীগ যুরু হয়েছিলো, সেই একই কারণেই লীডিং ক্লাবগুলো এই ইউরোপীয়ান সুপার লীগ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর সেটা হলো অর্থ। এই কোভিড মহামারীর কারণে পৃথিবীর অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো ফুটবল ক্লাবগুলোও ফিন্যানশিয়ালি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। স্পেনের দুই ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার ক্ষতির পরিমাণটা তুলনামূলক বেশি। তথ্যমতে, বার্সেলোনার দেনার পরিমাণ ১ বিলিয়নেরও বেশি, যেখানে রিয়াল মাদ্রিদের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৯০০ মিলিয়নেরও বেশি। আর এই ক্লাবগুলোর একটা বড় আয়ের উৎস হলো স্টেডিয়ামের দর্শকদের থেকে পাওয়া টিকেট বিক্রির অর্থ। কিন্তু কোভিড মহামারীর কারনে এক বছর ধরে স্টেডিয়ামে দর্শক আসা বন্ধ, তাই একটা বড় আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে আছে বড় ক্লাবগুলোর। এই সময়ে এতো বড় দেনা রাতারাতি পরিশোধ করা সম্ভব না, কিন্তু এই ইউরোপীয়ান সুপার লীগ ক্লাবগুলোকে সেই সুযোগ দিচ্ছে। সুপার লীগে জয়েন করলেই ৩.৫ বিলিয়ন ইউরো দেওয়া হবে যা ১৫ টি ক্লাবের মধ্যে ভাগ হবে, যেটা দিয়ে ক্লাবগুলো ইজিলি তাদের কোভিড এর কারণে সৃষ্ট ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। আবার নিউইয়র্ক টাইমসের দেওয়া তথ্যমতে সুপার লীগে জয়েন করলেই প্রতি ক্লাব পাবে ৪০০ মিলিয়ন ইউরো, যা গত বছর চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপাজয়ী বায়ার্ন মিউনিখকে দেওয়া প্রাইজমানির চার গুণেরও বেশি। আর এই এতো বেশি অর্থের যোগানের জন্য সুপার লীগ কর্তৃপক্ষ পেয়ে গেছে একজন ইনভেস্টর- আমেরিকার জেপি মরগান ব্যাংক।
অনেকেই আবার এই সুপার লীগকে দেখছেন উয়েফার করা দূর্নীতির বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ হিসেবে। উয়েফা তাদের দুই ক্লাব টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়নস লীগ ও উয়েফা ইউরোপা লীগ থেকে যে রেভিনিউ জেনারেট করে সেই তুলনায় আগেই বড় ক্লাবগুলোর পেছনে কম খরচ করতো। এরপর ২০১৮ সালে ক্লাবগুলোর বিরোধীতা থাকা সত্ত্বেও চালু করে নতুন টুর্নামেন্ট উয়েফা ন্যাশনস লীগ, যা প্লেয়ারদের ওয়ার্কলোড ও ইঞ্জুরিতে পড়ার সম্ভাবনা আরো বাড়িয়ে দেয়। তার উপর গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে উয়েফা কিছু ক্লাবের ক্ষেত্রে তাদের ফিন্যানশিয়াল ফেয়ার প্লে রুলের যথাযথ প্রয়োগ করছে না। এছাড়াও ক্লাবগুলোর উপার্জনের উৎস সম্পর্কেও নজরদারির বিষয়েও উয়েফা নিজেদের দায়িত্ব অবহেলা করছে। তার উপর এই প্যান্ডেমিকে বার্সা-রিয়াল ছাড়া আরো অনেক ক্লাবই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের ব্যাপারেও উয়েফার পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই সব কিছু মিলিয়ে ১২ টি ‘এলিট’ ক্লাব উয়েফার ছায়াতল থেকে বেরিয়ে এসে নিজেরাই চাচ্ছে একটি আলাদা টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে। যেখানে প্রতি সপ্তাহেই থাকবে কয়েকটি ‘বিগ’ ম্যাচের উত্তেজনা, আর বিগ ম্যাচ মানেই দর্শক বেশি ও রেভিনিউও বেশি। ফলে ক্লাবগুলোও উপার্জন করবে বেশি।
ক্লাবগুলোর দেওয়া বিবৃতি অনুযায়ী মাদ্রিদ চেয়ারম্যান ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ হবেন সুপার লীগের প্রেসিডেন্ট। ইউনাইটেডের জোয়েল গ্লেজার ও জুভেন্টাসের আগনেল্লি হতে যাচ্ছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। এছাড়া লিভারপুলের জন হেনরি ও আর্সেনালের স্ট্যান ক্র্যানকিও ভাইস চেয়ারম্যান হতে পারেন।
এই সুপার লীগের ইম্প্যাক্ট কেমন হতে পারে, তা নিয়ে এখনো কনফিউশানে আছে ফুটবল ফ্যানরা। ইউরোপীয়ান ফুটবলে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এই ‘এলিট’ ক্লাবগুলো। আর এই সুপার লীগে অংশগ্রহণ করলে এই দলগুলো যে উপকৃত হবে সেটা তো সবারই জানা। কিন্তু এর কয়েকটি খারাপ প্রভাবও ফুটবল মোকাবিলা করতে পারে। ২০১৭-১৮ সিজনে রোমার রূপকথা, ২০১৮-১৯ এ আয়াক্সের জুভেন্টাস ও মাদ্রিদকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠা, ২০১৯-২০ চ্যাম্পিয়নস লীগে আটালান্টা ও লাইপজিগের রচিত রূপকথা হয়তো আর দেখা যাবে না খুব একটা বিশ্ব ফুটবলে। কারণ সুপার লীগে খেলা দলগুলোর চ্যাম্পিয়নস লীগে খেলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই ঐ ছোট দলগুলো কিংবা ঐ দলগুলোর প্লেয়াররাও ‘এলিট’ ক্লাবগুলোর বিপক্ষে নিজেদের প্রমাণের সুযোগ পাবে না। জৌলুশ হারাবে চ্যাম্পিয়নস লীগ। যদি শেষ পর্যন্ত সুপার লীগে খেলা দলগুলো ডোমেস্টিক লীগে খেলার অনুমতি পেয়েও যায়, তারপরেও আগের মতো লীগের টপ ফোরে থাকার যে প্রতিযোগিতা তা আগের মতো যে হবে না, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘Greatest Game on Earth’ ফুটবল তখন হয়ে যাবে ধনী ক্লাবগুলোর খেলা। তাই বেশিরভাগ ফুটবল ফ্যান ও বেশ কয়জন সাবেক ফুটবলার এর বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছেন। লিভারপুলের ফ্যানরা ইতোমধ্যে এনফিল্ডের বাইরে পোস্টার টাঙিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। ইউনাইটেড আইকন গ্যারি নেভিল ও স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন এই সুপার লীগের সমালোচনা করেছেন। গতকাল লীডস ইউনাইটেড-লিভারপুল ম্যাচ শুরুর আগে লীডসের প্লেয়াররা ‘Earn It’ লেখা ট্রেইনিং কীট পড়ে অনুশীলন করেছেন, লিভারপুল কোচ ইউর্গেন ক্লপও সুপার লীগের সমালোচনা করেছেন। প্রিমিয়ার লীগের সুপার লীগে জয়েন হওয়া ৬টি ক্লাবের সাপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন তাদের নিজ নিজ বিবৃতি দিয়েছেন এটার বিরোধিতা করে। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও টুইটারে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। এখন আসলে ফুটবলের ভবিষ্যত অনেকাংশেই নির্ভর করছে উয়েফা ও ১২ টি ক্লাবের উপর। ফুটবল ফ্যানদের এটাই আশা যে তারা আলোচনা করে এমন একটা সিদ্ধান্তে আসবেন, যাতে ঐ ১২টি ক্লাবের পাশাপাশি অন্যান্য ছোট ক্লাব ও তাদের প্লেয়াররা সর্বোপরি ফুটবল উপকৃত হবে।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!