"হত্যা নয়, বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন: ডিবি"- এই সংবাদের প্রেক্ষিতে ১৫ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় বুয়েট শহীদ মিনার এর সামনে মানববন্ধনের সিদ্ধান্ত নেয় বুয়েটের শিক্ষার্থীগণ। এর প্রেক্ষিতে ১৪ ডিসেম্বর রাতেই ডিবি কার্যালয় থেকে বুয়েট শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাদের বক্তব্যের পক্ষে তথ্য প্রমাণাদি পেশ করার জন্য। শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে তদন্তকারী সংস্থার আলামত এবং প্রচেষ্টায় তারা সন্তুষ্ট হলেও উক্ত প্রমাণাদির সাপেক্ষে আত্মহত্যার যে কনক্লুশন টানা হয়েছে তাতে তারা শতভাগ নিশ্চিত নয়। তাদের মতে প্রমাণাদির মধ্যে অনেক গ্যাপ রয়েছে যেসব নিয়ে তদন্তকারী সংস্থা কাজ করছে। তবে আলামতগুলো থেকে ফারদিন আসলেই আত্মহত্যা করেছে কিনা সে ব্যপারে শতভাগ নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি বলে তারা জানান।
প্রমাণাদি পর্যবেক্ষণের নিমিত্তে ১৫ তারিখ আনুমানিক সকাল সোয়া ১১টার দিকে ডিবি কার্যালয়ে প্রাথমিক ভাবে ১০জন এবং পরবর্তীতে মোট ৩১ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত হন। শুরুতে ডিবির পক্ষ থেকে ঘটনার একটি ব্রিফিং দেয়া হয় যেখানে ঐ রাতের সব ঘটনাক্রম স্থানসহ তাদের পক্ষ থেকে যুক্তিসহ উপস্থাপিত হয়।
ডিবির উপস্থাপিত প্রমাণাদি:
১.মিডিয়ায় তাদের পরিবেশিত ফুটেজ ।
২.ফারদিনের কল হিস্ট্রি, ইন্টারনেট ও লোকেশন হিস্ট্রি। শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত কোন কোন ওয়েবসাইট/অ্যাপ ব্যবহার হয়েছে তার বিস্তারিত ফরেন্সিক আলামত।
৩.একুইরেট লোকেশন ট্র্যাকিং:ঘটনার দিন চলাফেরার ডিটেইল্ড রোডম্যাপ ট্রাক করতে পেরেছে বলে জানান ডিবি পুলিশ। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করেন লোকেশন সংক্রান্ত র্যাব এবং ডিবির দেওয়া তথ্যে রকমফের কেন? উত্তরে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে ফারদিনের জিপি নাম্বার ব্রিজের সংলগ্ন টাওয়ারে আর রবি নাম্বার নদীর ওপারে চনপাড়ার টাওয়ারে সংযুক্ত ছিল এবং দুইটাই কার্যত একই লোকেশনকেই কাভার করে। তাই র্যাবের দেওয়া তথ্য ভুল হয়নি।
৪.একইসাথে বিস্তারিত ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করা হয় যে প্রথমে পূর্ব পরিকল্পিত খুন এবং পরে মাদকব্যবসায়ী/ছিন্তাইকারী সন্ত্রাসীদের হাতে হত্যাকাণ্ড হয়েছে এমন ধারণা করেই তদন্তকাজ শুরু করা হয়। এর প্রেক্ষিতে গত এক বছরে যে ৫২২ নাম্বারে ফারদিনের কথা হয়েছে এবং তারা যাদের সাথে গত কয়েকদিনে কথা বলেছেন এমন সবার লোকেশন চেক করা হয় এবং কোন ধরনের ক্লু আছে কিনা তা যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কারও লোকেশন ঐ ঘটনার সময় ব্রিজের আশেপাশে পাওয়া যায়নি এবং বুয়েট ও বাইরের বন্ধুদের সাথে কথা বলে তারা তেমন শত্রুতার কোনো সম্ভাবনাও পাননি।
৫.উক্ত এলাকায় ডিবি সোর্স ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু ঐ রাতে ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় কোনোরকম অস্বাভাবিক ঘটনার কথা জানা যায়নি।
৬. লেগুনাচালককে টানা জিজ্ঞাসাবাদ ও অবজার্ভেশনে রাখা হয়। তার কাছ থেকেও তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
৭.তদন্ত কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে "সুলতানা কামাল ব্রিজের তারাবো অংশে নামার পর ফারদিন আবার ব্রিজে ফেরত এসে মাঝখানের অংশে দাঁড়িয়ে লাফ দেয়"। তবে এই হাটার দূরত্বটুকুতে কোনো সিসি ক্যামেরা ফূটেজ তারা পাননি, অর্থাৎ এটা ১০০% নিশ্চিত নয় যে ফারদিন স্বেচ্ছায় একা একা ব্রিজ থেকে লাফ দিয়েছিল। তাদের ভাষ্যমতে ফারদিন সেই রাতে ঐ ব্রিজের উপরের ছিল, যেটা উনারা মোবাইল টাওয়ার সেলের কভারেজ এরিয়ার মাধ্যমে পেয়েছেন এবং এটাকে অন্যতম ক্লু হিসেবে উল্লেখ করেন।
সুইসাইডের সম্ভাবনার পক্ষে ডিবির কিছু সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স তুলে ধরা হয়। এক্ষেত্রে তারা ফারদিনের গত একবছরে কিছু চ্যাটে বলা মৃত্যুচিন্তা বা সুইসাইডের কথা তুলে ধরেন। তাদের ভাষ্যমতে ফারদিন ঝাঁপ দেয়ার আগে ফোনে একটা ক্লাসিকাল মিউজিক পিস শুনে। একইসাথে তারা মনে করেন যে ফারদিনের রেজাল্ট তুলনামূলক খারাপ ছিলো, এজন্য মানসিকভাবে তার হতাশা থাকতে পারে।
তাদের প্রচেষ্টা এবং উপস্থাপিত প্রমাণাদি প্রাসঙ্গিক হওয়ায় এক্ষেত্রে সন্তুষ্ট হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা উক্ত প্রমাণাদির প্রেক্ষিতে আত্মহত্যা করেছে এমন সমাধানে পৌঁছানোয় সন্তুষ্ট নয়। তাদের যুক্তিতে কিছু গ্যাপ রয়ে গিয়েছে বলে শিক্ষার্থীরা জানান। তাদের মতে:
১.ঘটনার আগের ৪-৫ মিনিটে কি হয়েছে তা নিশ্চিত হবার কোনো উপায় নেই। ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় ফারদিনের চলাচলের কোন ফুটেজ ডিবি দেখাতে পারেনি। তাই ঐ ব্যাক্তিটি যে ফারদিন এমনটা নিশ্চিত ভাবে বলার সুযোগ নেই।
২. ব্রিজের উপর খুন হতে যেমন কোনো প্রত্যক্ষদর্শী দেখেনি, তেমন ব্রিজের উপর থেকে কাউকে ঝাঁপ দিতেও কেউ দেখেনি৷
৩.ফারদিনের কিছু চ্যাটে বলা মৃত্যুচিন্তা বা সুইসাইডের কথা যেগুলো দেখানো হয়েছে সেটা চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসের। সাম্প্রতিক সময়ের এমন কিছু দেখাতে পারেনি। এছাড়াও উপরিউক্ত বিষয়ে গত একবছরে বিভিন্নজনের সাথে মাত্র তিনটি চ্যাটের কথা উল্লেখ করেন ডিবি কর্মকর্তারা। এর মধ্যে একটি এমন ছিল "আমি মারা গেলে সাজ্জাদ সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে।"
এই ধরনের কথাবার্তা বর্তমান জেনারেশনের কিশোর বা যুবকরা সাধারণভাবেই বলে থাকেন। সর্বোপরি সুইসাইডের যে কারণগুলো দেখানো হয়েছে সেগুলো খুব কনক্রিট না এমনটাই মন্তব্য করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
৪.ফুটেজে ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেয়া ব্যক্তিটিকে দুই তিন সেকেন্ড ব্রিজের রেলিং ধরে ঝুলে থাকতে দেখা যায় । কেউ আত্নহত্যা করলে লাফ দিতে গিয়ে কেন ঝুলে থাকবে, এ ব্যপারেও অনিশ্চয়তা প্রকাশ করা হয়।
ডিবির সার্বিক কার্যক্রমের অগ্রগতিতে শিক্ষার্থীরা আশাবাদী, কিন্তু শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক বারবার বিভিন্ন অনুমান মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে যা ফারদিনের পরিবার, আপনজনদের জন্য কষ্টদায়ক বলে মনে করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে শিক্ষার্থীরা আশাবাদী যে তদন্ত সংস্থা তাদের উল্লিখিত তদন্তের মধ্যকার এই গ্যাপগুলো নিয়ে কাজ করছেন এবং দ্রুত এর একটি সুরাহা হবে। এবং গ্যাপগুলোর রহস্য উম্মোচনের পূর্বে তারা ঘটনাটিকে একটি আত্মহত্যার ঘটনা মানতে নারাজ।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!