নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি এবং ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে বুয়েট শহীদ মিনারে আন্দোলনরত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অফিশিয়াল বিবৃতি ও ৬ দফা দাবি নিম্নরূপঃ
"বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সবচেয়ে সমাদৃত এবং শীর্ষস্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর এ আবরার ফাহাদ ভাই এর নৃশংস মৃত্যুর মাধ্যমে বুয়েট বাংলাদেশ এর সবচেয়ে নিরাপদ ক্যাম্পাসে রুপ নেয়।
বুয়েটে সর্বশেষ ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে যে নিরাপদ এবং সুন্দর একটি ক্যাম্পাস আমরা উপহার হিসেবে পেয়েছি, তা দেশব্যাপী সকলের কাছে প্রশংসিত এবং অনুকরণীয়। দেশের সকল মানুষ, নানা প্রান্তের নানা প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষার্থী দেখেছে একটি রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের রোল মডেল,তার সুফল, তার সৌন্দর্য, তার উৎকর্ষের যত সমূহ সম্ভাবনা। তবে যে কলুষিত হাতগুলোর কারণেই ঝরে গিয়েছিল আমাদেরই নিষ্পাপ মেধাবী প্রাণ, সে কলুষিত হাতগুলো পরবর্তীতে বারে বারে ভিন্ন ভিন্নভাবে পুনরায় সে অপরাজনীতির অনুপ্রবেশের অপচেষ্টা চালিয়েছে, ক্যাম্পাসের এই সুন্দরতম ভিত্তিকে পুনরায় ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে। তবে ২০১৯ এর সেই সময়টির পর থেকে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে উদ্যম, সৎ সাহস আর প্রেরণা পেয়েছিল সেটিই প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছাত্ররাজনীতি অনুপ্রবেশ এর সকল অপচেষ্টাকে রুখে দিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট ঐক্য গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছিল। তবে এখনো বারে বারে পড়াশোনা কিংবা একাডেমিকস এর চূড়ান্ত চাপ থাকার পরেও আমাদের এই নিরাপদ ক্যাম্পাসটিকে রক্ষা করতে আমাদের সর্বদা সজাগ থাকতে হয়, করতে হয় নিরন্তর নিয়মিত সংগ্রাম। শিক্ষার্থীদের যেন সেই কলুষিত হাতদের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াই, সত্যের লড়াই চালিয়ে যাওয়া যেন শিক্ষাজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং নিত্য অংশ হয়ে গিয়েছে।
এমনই একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা আমাদেরই এই প্রাণের বুয়েট ক্যাম্পাসে ঘটে গত ২৮ মার্চ, ২০২৪ মধ্যরাতে। রাত ১ টার দিকে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানতে পারি, বুয়েটে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের বেশ কজন শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এসেছেন এবং তারা ক্যাম্পাসের মেইন গেইট দিয়েই প্রবেশ করে ভেতরে ঢুকেছেন। রাত সাড়ে ১০ টার পরে যেখানে নিরাপত্তাজনিত কারণে আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই ক্যাম্পাসে ঢোকার অনুমতি নেই সেখানে রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট বহিরাগত ব্যক্তিদের মধ্যরাতেই আমাদের প্রাণের ক্যাম্পাসে অনুপ্রবেশ ঘটে। ঘটনার তীব্রতা বাড়তে থাকে রাত বাড়ার সাথে সাথে, একের পর এক বহিরাগত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ক্যাম্পাসের মেইন গেইটের সামনে আসতে থাকে। বিপুল সংখ্যক বহিরাগত ক্যাম্পাসে অনায়াসে প্রবেশ করতে থাকে, এবং এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত সাধারণ শিক্ষার্থীরা দেখতে পায়, মিছিল এর মতন করে বিশাল একটি জনবহর হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে রাত ২ টার পর প্রবেশ করতে থাকে। দুঃখজনকভাবে, এই বিশাল জনবহর এর সকলেই বহিরাগত ছিল এবং তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করে মধ্যরাতের সেই সময়টাই বিশেষ ঐ ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দদের চিনতে পারে যা সুস্পষ্ট জানান দেয় এত বিপুল জনসমাগম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ এমন একটি ক্যাম্পাসে রাতের আঁধারে ঘটে যাওয়া এত বড় একটি রাজনৈতিক সমাগম এবং বহিরাগতদের আগমন ক্যাম্পাসের মর্যাদার প্রতি তীব্র অপমানজনক। একই সাথে এটি একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস এবং শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠ স্বাভাবিক শিক্ষা পরিবেশের নিরাপত্তার ব্যাপারকে গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তর কোনোরুপেই উক্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়ার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।
মধ্যরাতে বহিরাগত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের এমন দাপটসহ প্রবেশ কর্তৃপক্ষ এবং ডিএসডাব্লু এর দৃষ্টি অগোচরে হওয়া অসম্ভব। ঘটনা ঘটে যাওয়ার দেড় দিন পার হয়ে গেলেও ডিএসডাব্লু থেকে উক্ত ঘটনার সাথে সম্পর্কিত কোনো প্রকার সদুত্তর এবং জবাবদিহিতা এখন পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আসে নি। ক্যাম্পাসে মধ্যরাতে তারা প্রবেশের অনুমতি কিভাবে কর্তৃপক্ষ থেকে পেয়েছিল এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটি এখনো ধোঁয়াশাপূর্ণ এবং সন্দেহের সঞ্চার করে যে কিভাবে এবং কোন মদদে তারা প্রবেশ করতে পারলো। এর সমস্তই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটে বর্তমানে চলমান পাঁচটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিপুল সমালোচনার ঝড় ওঠে, তারা তাদের নিন্দা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এবং, প্রতিটি আলাদা আলাদা ব্যাচ নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা করে, তা অন্য ব্যাচদের সামনে তুলে ধরে এবং পরিশেষে সকল ব্যাচ কিছু সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এবং দাবি দাওয়ায় উপনীত হয়। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে অগ্রজ ব্যাচ ইন্টার্ভাল ১৮ প্রতিটি ব্যাচের ঐকবদ্ধ দাবিগুলোকে সুসংগঠিত করে নিম্নে পেশ করছে :
১. ২৮ মার্চ মধ্যরাতের ক্যাম্পাসে এমন অনুপ্রবেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধের নীতিমালা এর গুরুতর লঙ্ঘন এবং ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক চর্চা। এমন নীতিমালা বহির্ভূত রাজনৈতিক চর্চায় সে মধ্যরাতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ব্যাচের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বী। যে ঐ বিশেষ রাজনৈতিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে পূর্বে ক্যাম্পাসের অরাজনৈতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখতে তার পদ থেকে অব্যাহতি নিবে বলে জানায়, কিন্ত পরবর্তীতে এবং বর্তমানে সে অত্যন্তে প্রকাশ্যে তার রাজনৈতিক চর্চা চলমান রেখেছে। এবং ২৮ মার্চ মধ্যরাতে বহিরাগত দের সাথে নিরঙ্কুশ যোগাযোগ, তাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করানো, গার্ডদের সাথে কথা বলা, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সের সাথে সাক্ষাত, তাদের গাড়ি বের করানো কিংবা প্রবেশ করানো এই সকল সক্রিয় ভূমিকায় তাকে দেখা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্পষ্ট বিধিমালা লঙ্ঘনের দায়ে আমরা বুয়েটের সকল ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ২৮ মার্চের মধ্যরাতে রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক ইমতিয়াজ রাব্বি এর বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার এবং হল বাতিল এর দাবি জানাচ্ছি।
২. উক্ত ঘটনায় ইমতিয়াজ রাব্বির সাথে বুয়েটের বাকি যেসকল শিক্ষার্থীরা জড়িত ছিল তাদের বিভিন্ন মেয়াদে হল এবং টার্ম বহিষ্কার চাই।
৩. বহিরাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ যারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলো তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, তারা কেন কিভাবে প্রবেশ করার অনুমতি পেল এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট সদুত্তর এবং জবাবদিহিতা বুয়েট প্রশাসন কর্তৃক আসতে হবে।
৪. উপরোক্ত ১ নং এবং ২ নং দাবি আগামীকাল সকাল ৯ টার মধ্যে বাস্তবায়ন করা না হলে আমরা সকল ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ডিএসডাব্লু এর পদত্যাগ চাই ।
৫. ক্যাম্পাসে মধ্যরাতে বহিরাগতদের প্রবেশের কারণে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। এর প্রতিবাদ হিসেবে আগামী ৩০ ও ৩১ মার্চের টার্ম ফাইনাল সহ সকল একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করছি।
৬. আন্দোলনরত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোন রকম হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে না - এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
নিরাপদ ক্যাম্পাস এর নিশ্চয়তা, রাজনীতিবিহীন পরিবেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা বজায় রাখা সম্পূর্ণরুপে বিঘ্নিত হয়েছে ২৮ মার্চ মধ্যরাতের প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার মাধ্যমে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার সর্বদা বিরোধী।
আমাদের দাবি সমূহ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলমান থাকবে। "
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!