২০২৩ এর মে মাসের শুরুর দিকের কথা। সামনে তখন এতগুলো ভর্তি পরীক্ষা। এমন সময় হঠাৎ করে আমার ধরা পড়লো নিউমোনিয়া। চোখে অন্ধকার দেখলাম। শরীরের চেয়ে মন দুর্বল হয়ে পড়লো বেশি। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হল।
নাহ, এখানে আমার কথা বলবো না। বলতে চাই আমার পাশের বেডের গল্প। সেখানে এক মুমূর্ষু বৃদ্ধা কে ভর্তি করানো হল। দীর্ঘদিনের কিডনি জটিলতার সাথে সমস্ত শরীরে ইনফেকশান ছড়িয়ে গেছে। বাঁচার আশা ক্ষীণ। ভুল বললাম হয়তো। বছর কয়েক আগে আমার (পরলোকগত) নানুর যখন ক্যান্সার ধরা পড়ে, তিনি একদিন আমাকে বলেছিলেন, "বাঁচার আশা, কেউ কখনো ছাড়ে না।" কথাটা সত্যি।
পাশের বেডের সেই বৃদ্ধা সারাক্ষণ যন্ত্রণায় কাতরান। নাকে নল দিয়ে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা চলে। কাউকে চিনতেও পারেন না। তার কতগুলো আত্মীয় অর্থহীন ভাবে পাশে বসে থাকে। তার কষ্টের অবসান কামনা করে। তাকে বলতে থাকে, "তওবা করেন।" রোগী হাত তুলে বলেন, "আল্লাহ, হায়াত দাও!"
আমি অবাক হয়ে ভাবি, এত কষ্টের জীবন মানুষের। তবুও জীবনের প্রতি কী ভীষণ মায়া! আচ্ছা, জীবনের প্রতি প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় একজন মানুষ যখন নিজের হাতে প্রাণ শেষ করে দেয়, ঠিক শেষ মুহূর্তে, হয়তো একগাদা ওষুধ মুখে দেওয়ার আগে, কিংবা ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার মুহূর্তে, অথবা গলায় ফাঁস দেওয়ার সময়, আরেকটাবার কি জীবনটাকে সুযোগ দিতে ইচ্ছে হয় তাদের? ফাঁসিতে ঝোলানো মানুষটার গলায় যখন দড়িটা চেপে বসে, একটু একটু করে প্রাণ নিঃশেষ হতে থাকে, তখন কি হাত পা ছুড়ে তার চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়না, বাঁচাও বলে?
মৃত্যু দুয়ারে এলে বোধহয় বোঝা যায় প্রাণের মায়া। হয়তো তখন আরেকবার পৃথিবীটাকে দেখতে ইচ্ছে হয়। হয়তো প্রিয় মানুষগুলোর হাত ধরে বলতে ইচ্ছে হয়, ভালোবাসি। ভালোবাসতে চাই। আরো কয়েকটা দিন। ধরে রাখো আমায়। আরো কয়েকটা দিন।
সেই বৃদ্ধার অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। বেসরকারি হাসপাতালে রাখা আর সম্ভব হয়না। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সরকারি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। হয়তো উদ্দেশ্যহীন ভাবেই। তারপর? তার আর পর নেই। আছে শুধু জীবনের পরম সত্য।
জীবনানন্দ দাশের ভাষায়,
"গলিত স্থবির ব্যাঙ
আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়–
অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।"
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!