অক্সিজেন। যা বাতাসে পর্যাপ্ত পরিমানে আছে বলেই আমরা প্রানভরে শ্বাস নিতে পারছি। দুঃখের বিষয়, কোভিড-১৯ মহামারী সৃষ্টিকারী করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি মানুষের শ্বসনতন্ত্র কে তীব্র ভাবে আক্রমন করে। ফলশ্রুতিতে তীব্র শ্বাসকষ্ট হতে থাকে আক্রান্ত ব্যক্তির। রক্তের অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে থাকে। ছটফট করতে থাকে রোগী। যাদের অবস্থা গুরুতর, তাদের প্রাণরক্ষার্থে দ্রুততার সঙ্গে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হয়। মধ্যম পর্যায়ের আক্রান্ত ব্যক্তিদের ও অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়, অন্যথায় শ্বসনতন্ত্রের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যায়।
করোনা ভাইরাসের একের পর এক আক্রমণে বিপর্যস্ত দেশের চিকিৎসাখাত। বিশেষ করে করোনার 'ডেল্টা' ভ্যারিয়েন্ট দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় অক্সিজেন নিয়ে একপ্রকার হাহাকারের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সরবরাহ যন্ত্র তথা পর্যাপ্ত সিলিন্ডারের অভাবেই অনেক ক্ষেত্রে অক্সিজেন সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে, দেশের অক্সিজেন সংকট মেটাতে ত্রাতা রূপে আবিভূর্ত হয়েছে অংকুর ফাউন্ডেশন নামে দেশের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এখন পর্যন্ত দেশের ২০টি জেলায় ১৩৫ টি অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করেছে সংগঠনটি। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে, যেখানে লাগামছাড়া ভাবে করোনা সংক্রমিত হচ্ছিল, সেই জায়গা গুলোয় অক্সিজেন সরবরাহ করে অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রজেক্টের সূচনা করে অংকুর। চলতি বছরের ২১ মে, রংপুর ও দিনাজপুরে ১০ টি সিলিন্ডার দিয়ে যাত্রা শুরু করা হয়। এরপর থেকেই পুরোদমে চলছে অংকুর ফাউন্ডেশন এর অক্সিজেন সেবা কার্যক্রম। মূলত, যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ' অংকুর ইন্টারন্যাশনাল' এর একটি অংশ এই অংকুর ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশনটিতে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করছেন বিভিন্ন জেলার প্রায় ১৪০ জন বুয়েট শিক্ষার্থী। বুয়েট ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৮০ জন শিক্ষার্থী দেশজুড়ে কাজ করছেন অংকুর ফাউন্ডেশন এর বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়নে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার বাড়ার পর থেকে হুহু করে বাড়ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার এর দাম। চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে ১ হাজার ৪০০ লিটার এর অক্সিজেন সিলিন্ডার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম কিনতে প্রায় ১৫০০০ থেকে ১৬০০০ টাকা, যা পূর্বে ১২০০০ টাকায় বিক্রি হতো। তাই, ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার। তাছাড়া, ঢাকায় অক্সিজেন তুলনামূলক সুলভ হলেও, দেশের সব এলাকায় তা নয়। ফলে, আক্রান্ত রোগীদের বিভাগীয় শহর কিংবা ঢাকায় স্থানান্তর করতে হচ্ছে শুধু মাত্র অক্সিজেনের আশায়। এই পরিস্থিতিতে, অংকুর ফাউন্ডেশনের বিনামূল্যে দেশজুড়ে অক্সিজেন সরবরাহ দেশের মানুষের জন্য একপ্রকার আশীর্বাদ।
'বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা' প্রজেক্ট শুরু করার পেছনে কোনো অনুপ্রেরণা ছিল কি না - এই প্রশ্নের উত্তরে অংকুর ফাউন্ডেশন এর একজন ভলান্টিয়ার এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রজেক্ট এর কো-অর্ডিনেটর, বুয়েটের বস্তু ও ধাতব কৌশল বিভাগের ২০১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী জুবায়ের লিখন বলেন, "করোনার ক্রমাগত বৃদ্ধিতে মানুষের পাশে দাড়াতে চেয়েছিলাম আমরা। অন্তত একটা মানুষকে হলেও আমরা নিশ্বাস নিতে সাহায্য করবো। এটাই আমাদের প্রাপ্তি হবে। এখন পর্যন্ত ২০টি জেলায় থাকা আমাদের জেলা অ্যাম্বাসেডররা নিজ জেলায় থাকা অংকুরের সকল ভলান্টিয়ার দের নিয়ে সিলিন্ডার সেবা দিচ্ছে। আর সেন্ট্রালি আমরা শায়েস্তাগীর চৌধুরী স্যারের তত্বাবধানে সারা দেশে নেতৃত্ব দিচ্ছি।"
উল্লেখ্য, অংকুর ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা শায়েস্তগীর চৌধুরী একজন বুয়েট এলামনাস এবং বর্তমানে প্রবাসে আছেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব ও দিক নির্দেশনায় দেশজুড়ে অংকুর ফাউন্ডেশন এর ভলান্টিয়ার ও কো- অর্ডিনেটররা কাজ করছেন।
দেশ জুড়ে অক্সিজেন সরবরাহ করতে প্রয়োজন বিপুল অর্থসাহায্য ও সদিচ্ছা। এই বিশাল প্রজেক্ট এর ফান্ড কিভাবে জোগাড় হচ্ছে জানতে চাইলে জুবায়ের লিখন বলেন, " অংকুরের নিজস্ব ফান্ড আছে। এছাড়াও দেশে বিদেশে থাকা অংকুরের অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাদের সিলিন্ডার পারপাসে অর্থ সহযোগিতা করছে।"
এদিকে, অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রজেক্ট সহ মানবহিতৈষী আরো অনেক প্রজেক্ট এর জন্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে অংকুর ফাউন্ডেশন। ওয়াজেদ সৌমিক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে অংকুরের অক্সিজেন সিলিন্ডার সেবা প্রজেক্ট নিয়ে বলেন, "অনেক মহৎ উদ্যোগ। বর্তমানে অক্সিজেন নিয়ে যেই রকম সিন্ডিকেট বানিজ্য চলতেছে তার মাঝেও বিনামূল্যে মানুষের পাশে দাড়ানোর কথা যে আপনারা ভেবেছেন ভাবতেই ভাল লাগছে। ভালবাসা অবিরাম।" আলম ভয়েজ নামে আরেকজন ফেইসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, " অংকুর ফাউন্ডেশন কে ধন্যবাদ জানাই হাজারবার , আমার বাড়ির পাশে এক প্রতিবেশী রোগী কে বিনামূল্যে অক্সিজেন সরবরাহ করলেন এই মাত্র। সকলের জন্য দোয়া করি।"
অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রজেক্ট নিয়ে ভবিষ্যতে আরো কোনো পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে জুবায়ের লিখন বলেন, "৬৪ টি জেলাতেই আমাদের সিলিন্ডার হাব করতে পারবো এটাই আমাদের পরিকল্পনা। এদেশ করোনা যুদ্ধে আমাদের অংশগ্রহণ চলমান থাকবে ইনশাআল্লাহ।"
কিভাবে পাবেন অংকুরের বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা?
অংকুর ফাউন্ডেশন এর হটলাইনে ফোন দিয়ে রোগীর অবস্থা জানালে, বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা জানাবেন অক্সিজেন প্রয়োজন কি না অথবা কতটা প্রয়োজন। এরপর, তাদের টেকনিশিয়ানরাই নিজ দায়িত্বে সিলিন্ডার সহ আপনার বাসায় যেয়ে সিলিন্ডার স্থাপন করে দিয়ে আসবে।
অংকুর ফাউন্ডেশন এর সেবা পেতে কিংবা তাদের পথযাত্রায় সামিল হতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন তাদের ফেইসবুক পেইজে।
লিঙ্কঃ অংকুর ফাউন্ডেশন
বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। অক্সিজেনের অভাবে বাড়ছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের হাহাকার। অংকুরের মত দেশের সকল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো মানবকল্যানে একযোগে কাজ করলেই হয়তো স্মরণকালের সবচেয়ে বড় এই করোনা মহামারীর মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!