চলমান করোনা পরিস্থিতিতে LMS(Learning Management System) ব্যবহার করে অনলাইনে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ৮ জুলাই, একাডেমিক ক্যালেন্ডারের ১২তম সপ্তাহে আসা নোটিশে (এসি/অনলাইন/২০২১/রে-০১২(৫০)) স্নাতক পর্যায়ে LMS ব্যবহার করে অনলাইন টার্ম ফাইনাল নেওয়ার নীতিমালা প্রণয়নের জন্য ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
অনলাইন টার্ম ফাইনাল এর নীতিমালা প্রণয়নের কমিটির কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে-
১.বিশেষ Digital IP Camera ব্যবহার করে Proctoring সুবিধাসহ উপযুক্ত LMS software (Zoom, Moodles, MS Teams etc.) এর মাধ্যমে অনলাইন টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা অনুষ্ঠান করার নীতি প্রণয়ন করা।
২. সর্বোত্তম সংখ্যক শিক্ষক দ্বারা ছোট আকারের গ্রুপে শিক্ষার্থীদের গ্রুপিং করে অনলাইন পরীক্ষা স্বাচ্ছন্দ্যে তদারক করা ও পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা।
৩. সম্ভাব্য প্রতারণা এড়াতে প্রশ্নের ধরণ যেমন MCQ,Open Book, Design Question ইত্যাদির সম্পর্কে ব্যাখ্যা ও গঠন সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান এবং বিভাগ অনুযায়ী পরীক্ষার সময়সূচির সর্বোচ্চ সময়কাল সম্পর্কে সুপারিশ করা।
৪.অন্য যে কোন বিষয়ে কমিটির প্রয়োজন মনে করলে মন্তব্য ও সুপারিশ করা।
করোনা পরিস্থিতিতে গতবছর মার্চে ক্লাস বন্ধ হওয়ার পর গত বছরই অনলাইন ক্লাস শুরু করে বুয়েট। নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে একটি টার্ম ফাইনালও গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। তবে চলতি বছর জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত হওয়া টার্ম ফাইনালটি ছিলো অনলাইন আনগ্রেডেড। কেবল Satisfactory/Fail এর ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয় উক্ত টার্ম ফাইনাল। গ্রেড নিয়ে কোনোরূপ চিন্তা না থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রতিকূলতা কাটিয়ে টার্ম ফাইনালে অংশগ্রহণ করে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় একটি S/F টার্ম ফাইনালে অংশ নেয়ার পরও ক্যাম্পাসে ফিরতে ব্যর্থ হয় বুয়েট। আবারও অনলাইনে নতুন টার্ম শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। এবার আর এস/এফ নয়, বরং গ্রেডেড।
ইতোপূর্বে বুয়েট কর্তৃপক্ষ দাড়া গৃহীত অনলাইন ক্লাস সংক্রান্ত নীতিমালায় স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা নেয়ার কথা বলা হলেও বর্তমানে এর বিপরীতে গিয়ে অনলাইনে গ্রেডেড টার্ম ফাইনাল নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১ তারিখে প্রকাশিত উক্ত নোটিশে (এসি/অনলাইনশিক্ষাকার্যক্রম/স্নাতক/রে-৩২৬০(৮০)) ক্লাস উপস্থিতি ও পরীক্ষা সংক্রান্ত নীতিমালার (পৃষ্ঠা ৩) ৪র্থ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়,
ক) ফাইনাল পরীক্ষা স্বয়ং উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হবে।
খ) যদি কোভিড-১৯ মহামারী শেষ হয়ে যায়, এবং/অথবা সরকারী নীতিমালা বর্তমান টার্মের ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে পরীক্ষা নেয়ার অনুমতি দেয়, তবে তিন সপ্তাহ প্রস্তুতি ছুটি দেওয়া হবে এবং টার্ম ফাইনাল স্বাভাবিক নিয়মে অনুষ্ঠিত হবে, সামাজিক দূরত্বের নীতিমালা অনুসরণ করে।
পুরো টার্ম অফলাইনে পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এখন অনলাইনে টার্ম ফাইনালের সিদ্ধান্ত আসায় নানা জটিলতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অনলাইন ক্লাস নিয়ে পূর্ব থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত বুয়েটের শিক্ষার্থীদের উপর এবার চেপে বসেছে অনলাইন টার্ম ফাইনালের নতুন দুশ্চিন্তা।
সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অনলাইন কার্যক্রমে অংশ নিয়ে চলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগের দুর্বলতা রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীকে রাস্তায়, মাঠে থেকে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে হয়েছে। আবার অনেকে শহরে মেসে থেকে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিয়ে থাকে। সিটি, ল্যাবটেষ্টে অনেকে আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে অংশ নেয়। চলমান লকডাউনে উক্ত সুযোগগুলি কমে আসায় অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতেই হিমশিম খাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এমতাবস্থায় কর্তৃপক্ষ থেকে যে পদক্ষেপই নেওয়া হোক নে কেন, সবার সমান সুযোগ নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। গ্রামাঞ্চলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের কেবল আর্থিক সহায়তা করে নেটওয়ার্ক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের একটি বৃহৎ অংশ এখন করোনা আক্রান্ত কিংবা করোনার লক্ষণ প্রদর্শন করছে এবং অনেকেরই পরিবারের সদস্য আক্রান্ত। ২৮ জুন ২০২১ এর একটি জরিপে দেখা যায় ২৩৬০ জন জরিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ২৯.৩ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজে অথবা পরিবারের সদস্যদের করোনার লক্ষণ পাওয়া গিয়েছে। আবার জরিপের ১১.৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবার ইতিমধ্যেই করোনা আক্রান্ত। ২৮ জুনের উক্ত জরিপের পর আরো অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, অনেকে হারিয়েছে নিজের বাবা/মা আবার অনেকের ভাই/বোন রয়েছে শঙ্কাজনক অবস্থায়। স্বাভাবিকভাবেই ভুক্তভোগী এই শিক্ষার্থীদের পক্ষে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সম্ভব নয় এবং পরবর্তীতে তাদের পরীক্ষা কীভাবে নেওয়া হবে তা নিয়েও যথেষ্ট বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে।
টার্মের ১২তম সপ্তাহে এসে পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন করায় (MCQ, Open Book, Design Question) ভীতির সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। প্রচলিত পদ্ধতিতে লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে অন্য পদ্ধতিতে পরীক্ষা দেওয়া কার্যত অসম্ভব। বুয়েটের একটি টার্মে ১৪ সপ্তাহ ক্লাস এবং পরবর্তীতে ৩/৪ সপ্তাহ প্রস্তুতি ছুটির পরে টার্ম ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। ১২ সপ্তাহে বেশিরভাগ কোর্সেরই ক্লাস প্রায় শেষের দিকে, ক্লাসটেস্ট অধিকাংশ হয়ে গেছে। অর্থাৎ টার্ম ফাইনাল ছাড়া টার্ম মোটামুটি শেষই বলা যায়। এই শেষ মুহূর্তে এসে পরীক্ষার ধরণ পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার্থীদের ভয় ও মানসিক চাপে ফেলে দিয়েছে। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে একটি টার্ম ফাইনাল অনলাইনে দিয়েছে। বিগত টার্ম ফাইনালটিতে ৪০% গ্রেড ছিলো ক্লাসে মূল্যায়্নের উপর এবং ৬০% ছিলো টার্ম ফাইনালের উপর। টার্মটি এমনভাবে সম্পন্ন হয় যাতে ক্লাস মূল্যায়নেই প্রয়োজনীয় মার্ক আসা সম্ভব হয়। তাই অনেক প্রতিকূলতা থাকা সত্বেও গত টার্ম ফাইনানে শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারে। কিন্তু চলতি টার্মে ক্লাস মূল্যায়নে ৩০% এবং টার্ম ফাইনালে রয়েছে ৭০%, বুয়েটের গতানুগতিক নিয়ম অনুসারে। এমতাবস্থায় টার্ম ফাইনাল প্রতিটি কোর্সের অধিকাংশ মার্ক বহন করছে। আর একই কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য পরীক্ষায় ভালো করতে না পারলে সেটা শিক্ষার্থীদের গ্রেডের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। অনলাইন টার্ম ফাইনাল একাডেমিক পড়াশোনা ছাড়াও আরও অনেককিছু বিবেচনায় নিয়ে আসে- ইন্টারনেট ইস্যু, নেটওয়ার্ক ইস্যু, ডিভাইস ইত্যাদি। এই সমস্যাগুলোয় যেকোনো সময় যেকোনো শিক্ষার্থী পড়তে পারে। কোভিড মহামারীর পূর্বে পরীক্ষাহলে বসে যে নিরিবিলি পরিবেশে টার্ম ফাইনাল দিয়ে অভ্যস্ত শিক্ষার্থীরা সেটা এমন অবস্থায় অসম্ভব।
৭০% মার্কধারী টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় হঠাৎ ইন্টারনেট সংযোগ চলে যাওয়া কিংবা উত্তরপত্র সাবমিট করার সময় ডিভাইসে সমস্যা দেখা দেয়ার মত সমস্যার সম্মুখীন হওয়া প্রচন্ড পরিমাণে মানসিক চাপ তৈরি করতে সক্ষম। বিগত প্রায় এক বছরের অনলাইন ক্লাস এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় এমন নেটওয়ার্ক বা ডিভাইসের অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যাগুলো অত্যন্ত বেশি এবং প্রায় ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের এ ব্যপারে প্রতিক্রিয়া অনমনীয়। এমন অবস্থায় অনলাইনে গ্রেডেড টার্ম ফাইনালের নোটিশটি শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপে ফেলে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ৬৪.৯% শিক্ষার্থী হল খুলে অফলাইনে গ্রেডেড পরীক্ষার পক্ষে। এছাড়া অনলাইনে S/F পরীক্ষার পক্ষে ২০.৭% শিক্ষার্থী এবং অনলাইনে গ্রেডেড পরীক্ষার পক্ষে ১৪.৪% শিক্ষার্থী। উল্লেখ্য, বুয়েটে শিক্ষার্থীদের কোভিড-১৯ টিকা নেওয়া বহুলাংশে সম্পন্ন হয়েছে এবং অবশিষ্টদের টিকা কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে। এমতাবস্থায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীর টিকাপ্রদান সম্পন্ন করে অফলাইনে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়া অবশ্যই সম্ভব। এবং শিক্ষার্থীদের জরিপ থেকেও পরিষ্কার যে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অফলাইনে গ্রেডেড পরীক্ষা দিতে চায় এবং তারা অনলাইনে গ্রেডেড পরীক্ষার ব্যপারে উদ্বিগ্ন।
সূত্রঃ
এসি/অনলাইন/২০২১/রে-০১২(৫০ঃ
https://www.buet.ac.bd/info/NewsEvent#/contentdetail/4786
এসি/অনলাইনশিক্ষাকার্যক্রম/স্নাতক/রে-৩২৬০(৮০ঃ
https://www.buet.ac.bd/info/NewsEvent#/contentdetail/4545
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!