গেল বছর, ৮ মার্চ ২০২০ তারিখে দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর থেকে, কখনোই এই ভাইরাস সংক্রমণকে প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় নি। যার ফলশ্রুতিতে প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর এবার করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ চলছে। আশঙ্কা ও আতঙ্কের বিষয় এই যে, প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের চেয়ে বর্তমানে চলমান তৃতীয় ঢেউ অনেক বেশি তীব্র। শনাক্তের হার বাড়ছে হুহু করে। এই রিপোর্ট লেখাকালীন সময়ে, অর্থাৎ জুলাই ৯, ২০২১ এ, করোনা সন্দেহে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ৩৬৫৮৬, যার মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১১৩২৪ জনের। শনাক্তের হার প্রায় ৩০.৯৫% ! চব্বিশ ঘন্টায় মৃতের সংখ্যা ২১২ জন, যা বিগত প্রায় দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ!
এদিকে, গত দেড় বছর ধরে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দিয়েও বারবার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন। বুয়েটও সশরীরে বা অফলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও একরকম বাধ্য হয়েই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মত বুয়েটে চালু রয়েছে অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রম। ইতিমধ্যেই একটি সেমিস্টার সম্পন্ন হয়েছে, আরো একটি প্রায় শেষের পথে।
এরই মধ্যে, করোনার করাল থাবায় চলতি বছরের মে মাসে বুয়েট হারিয়েছে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক, ড. মজিবর রহমান স্যার ও একই বিভাগের অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক, ড. তাইফুর স্যারকে।
এদিকে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসার পর থেকে সরকার পুনরায় লকডাউন ঘোষণা করে। সংক্রমণের তীব্রতা ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় জুলাই ১ থেকে শুরু হওয়া লকডাউনের সময়সীমা দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে।
এই সংকটময় অবস্থায় শিক্ষার্থীদের ও তাদের পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে সার্বিক ধারণা পেতে গত ২৮ জুন ২০২১ তারিখে একটি অভ্যন্তরীণ জরিপ চালায় বুয়েট শিক্ষার্থীরা। জরিপে অংশ নেয় ২৩৬০(প্রায় ৫০%) জন শিক্ষার্থী। উক্ত জরিপ থেকে জানা যায়: ৪৮২ জন শিক্ষার্থীর তাদের নিজের বা নিজের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে করোনা আক্রান্তের লক্ষণ পাওয়া গেছে। যা জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ২৯.৩%। ২৭২ জন শিক্ষার্থীর পরিবার ইতিমধ্যেই করোনা আক্রান্ত। অর্থাৎ প্রায় ১১.৫% শিক্ষার্থীর পরিবার আক্রান্ত হয়েছে। ৪৫ জন শিক্ষার্থী নিজেরা করোনা আক্রান্ত।
অবশ্য, ২৮ জুন এই জরিপের পরেও নতুন সংক্রমণ ঘটেই চলেছে এবং প্রায় প্রতিদিনই দুঃসংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের একটি বড় অংশ ইতোমধ্যেই আক্রান্ত। গত এক সপ্তাহে অসংখ্য শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও, প্রাণ হারিয়েছেন বুয়েটের বেতন শাখার একজন স্টাফ ও DAERS অফিসের একজন অফিসার।
শিক্ষার্থীদের প্রায় ৭০ শতাংশ ঢাকার বাইরে অবস্থান করছে। এরমধ্যে অনেকেই আছে খুলনা রাজশাহীসহ বিভিন্ন করোনার হটস্পট বিভাগে। একদিকে প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা নতুন রেকর্ড ভাঙছে, অন্যদিকে হাসপাতালে জায়গা সংকট, অক্সিজেন সিলিন্ডারের অপ্রতুলতা জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। ১৭ ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী হারিয়েছে তার বাবাকে। অন্যজন মাকে বাঁচাতে না পারার কষ্ট নিয়ে, ভাই ভাবীসহ নিজেও সংকটাপন্ন অবস্থায় ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। দাদা দাদীর শেষ সময়ে তাদের পাশে না থাকতে পেরে অনুতাপ প্রকাশ করছে কেউ কেউ। হাসপাতালে অসুস্থ বাবার শয্যার পাশে থেকেই পরেরদিন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন। পাড়া প্রতিবেশির অসুস্থতা, নিকট আত্মীয়দের একের পর এক মৃত্যু সংবাদে বিদ্ধস্ত শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা। অন্যদিকে লকডাউনে কারো কারো পরিবারের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর উপরে চেপে বসছে করোনার ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ। বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা চেষ্টা করছে ফান্ড তুলে সহপাঠীদের কষ্ট লাঘব করতে। জীবনের নিশ্চয়তা যেখানে নেই, চারিদিকে যেখানে সহপাঠীদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর সংবাদ, সেখানে সুস্থভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে পারছেন না অনেকেই।
অন্যদিকে লকডাউনে সকল দোকানপাট বন্ধ থাকায় ডিভাইস মেরামত সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছে অনেকেই। নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুতবিভ্রাটজনিত সমস্যায় বাধ্য হয়ে শহরাঞ্চলের বিভিন্ন আবাসিক হোস্টেলে বসবাস করছিলেন অনেক ছাত্র। লকডাউনে হোস্টেল বন্ধ ঘোষণা করায় গ্রামাঞ্চল থেকে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। সার্বিক এই শোচনীয় পরিস্থিতিতে, মানবিক দিক বিবেচনায় মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের কাছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের এই পিক সময়ে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার আবেদন জানায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অন্তত যাতে সর্বাত্মক লকডাউনে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয় সেই আর্জি জানানো হয়।
শিক্ষার্থীদের এই আবেদনে সাড়া দেননি মাননীয় উপাচার্য মহোদয়। তার মতে, আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা 'উল্লেখযোগ্য' নয়। মাননীয় উপাচার্য মহোদয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিকট করোনা আক্রান্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা 'উল্লেখযোগ্য' মনে না হবার একটি কারণ হতে পারে ঢাকা জেলায় সংক্রমণের নিন্মহার। তৃতীয় ঢেউ আসার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে অন্যান্য জেলার তুলনায় রাজধানী ঢাকায় সংক্রমণের হার তুলনামূলক কম। উদাহরণস্বরূপ, গত এক মাসে, খুলনা বিভাগে সংক্রমণের গড় হার ৪৭%, রাজশাহীতে ৩০%, বরিশালে ২৮%। গত এক মাসে ঢাকা বিভাগে সংক্রমণের গড় হার ২৩%, যা তুলনামূলকভাবে কম। তাছাড়াও ঢাকার বাইরে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই টিকাপ্রাপ্তির সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত। অন্যদিকে, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের একটি বড় অংশ ঢাকায় বুয়েট এর টিচার্স কোয়ার্টারে থাকেন এবং বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের অনেকেই টিকাপ্রাপ্ত। বর্তমানে কয়েকজন শিক্ষক কোভিড পজিটিভ হলেও সেখানে সংক্রমণের হার অনেক কম। শিক্ষার্থীদের অনুযোগ, এই কারণেই দেশজুড়ে চলা মহামারীর তীব্রতা ও দুর্দশার কথা তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।
করোনা আক্রান্তদের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ 'কোভিড পলিসি' ঘোষণা করেছে। উপাচার্য মহোদয়ের পরামর্শ, করোনা আক্রান্তরা চাইলেই এই পলিসি গ্রহণ করে ১৪ দিনের ছুটি নিতে পারে। করোনা পৌনঃপুনিকভাবে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আঘাত হানছে। করোনার কারণে বারবার শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করলে তা বুয়েটের আন্তর্জাতিক মান অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করবে জানিয়ে সর্বাত্মক লকডাউনের মাঝেও অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন তিনি। অন্যদিকে অসুস্থ শিক্ষার্থীদের টার্মের শেষদিকের ফাইনাল কুইজ এবং ল্যাবটেস্টগুলো কবে নেওয়া হবে সেবিষয়েও আসেনি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। তাছাড়াও নিজে অসুস্থ না হলেও পরিবারের কোভিড আক্রান্ত বাবা মা বা অন্যান্য স্বজনদের শুশ্রুষার গুরুদ্বায়িত্ব বহনের সাথে সাথে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীকে।
চলছে লকডাউন, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এর সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। দেশ ও জাতির এই ক্রান্তিলগ্নেও বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে নেবার ঘোষণায় অসন্তুষ্ট শিক্ষার্থীদের বৃহদাংশ।
করোনা সংক্রান্ত তথ্যসূত্রঃ http://103.247.238.92/webportal/pages/covid19.php
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!