আজ ৮ই জুন সনি হত্যা দিবস। উনিশ বছর আগে শনিবার, ৮ই জুন ২০০২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনি প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয়ে যান নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সনি বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের 'স্বাপ্নিক' ৯৯ ব্যাচের, লেভেল-২, টার্ম-২ এর শিক্ষার্থী ছিলেন। সেদিন বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের দুই গ্রুপের মধ্যে টেন্ডার বাজি সংক্রান্ত দ্বন্ধে প্রান হারান এই মেধাবী শিক্ষার্থী।
উক্ত হত্যা কান্ডের সাথে জড়িতদের মধ্যে অন্যতম তৎকালীন বুয়েট ছাত্রদলের সভাপতি মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি ও তার অনুসারী শরীফ, সায়হাম, স্বপন, মামুন গাজি, ইকবাল, জাহিদ সহ আরও অনেকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের তৎকালীন ছাত্রদলের টগর ও তার অনুসারীরা।
২০০২ সালের ৮ জুন টেন্ডার বাজি নিয়ে বিরোধে , বেলা পৌনে একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে নেমেছিল তৎকালীন বুয়েট ছাত্রদলের মুকি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের টগর গ্রুপ। সেইসময় পলাশী ও আশেপাশের এলাকার চাঁদাবাজি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল ক্যাডাররাই দেখভাল করতো। তৎকালীন ছাত্রদল ক্যাডার এস এম হলের টগর ছিল এই টেন্ডার ও চাঁদাবাজির সর্বেসর্বা। অন্যদিকে চট্টগ্রামের কুখ্যাত সাকা চৌধুরীর অনুগত ও তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি পিন্টূর অতি আদরের ছোট ভাই, মোকাম্মেল হায়াৎ খান মুকী ছিল ছাত্রদল বুয়েট শাখার সভাপতি। কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারন সম্পাদকের পদটিও ছিল তার দখলে। ২০০২ সালের জুন মাসের শুরুর দিকে বেশ বড় অংকের টেন্ডার কেন্দ্র করে, টগর-মুকীর শক্তিমত্তার চূড়ান্ত পরীক্ষা অনিবার্য হয়ে উঠে।
প্রথম দফা গোলাগুলি থেমে গেলে আহসানউল্লাহ হলের ভেতর আশ্রয় নেয়া সাবেকুন নাহার সনি বের হয়ে আসেন। কয়েক পা ফেলে সামনে এগুতেই অস্ত্রের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। আনুমানিক আধঘণ্টা পর তাঁকে সেখান থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে হয়,সেখানে তার মৃত্যু হয়।
হত্যাকাণ্ডের রাতেও খুনিরা অবস্থান করছিল বুয়েটের ড. এম এ রশীদ হলে। বিক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রশীদ হল ঘেরাও করে ফেলে। প্রশাসনকে খুনিদের গ্রেপ্তারের জন্য জানানো হলে তারা কোনো উদ্যোগ নেয়নি । এবং আন্দোলন দমনের কৌশল হিসেবে পরদিন ৯ জুন,২০০২ বুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এই বন্ধের মধ্যেও সারা দেশে আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ২ মাস পর পুনর্বার খোলার সাথে সাথে আন্দোলন নব উদ্যমে শুরু হয়। ক্রমাগত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সনি হত্যাকাণ্ড মামলার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করা হয় এবং মামলার রায়ে সন্ত্রাসী মুকী, টগরসহ তিনজনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। এই মামলার রায় ছিল বাংলাদেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের প্রথম বিচার।
মূল আসামীদের একজন মোকাম্মেল হায়াৎ খান মুকীর অনুপস্থিতিতেই ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতের বিচারপতি শাহেদ নুরুদ্দিন ২০০৩ সালের ২৯ জুন টগর, মুকীর ফাঁসির আদেশ দেন। পরবর্তীতে আসামী পক্ষের আপীলের প্রেক্ষীতে ২০০৬ সালের ১০ মার্চ হাইকোর্ট মুকিত, টগর ও সাগরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এ ছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এসএম মাসুম বিল্লাহ ও মাসুমকে খালাস দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টে দণ্ডিত দুই আসামি এখনো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামি মোকাম্মেল হায়াত খান মুকি তৎকালীন সরকারী দলের প্রত্যক্ষ মদদে দেশ ছেড়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। পলাতক রয়েছে নুরুল ইসলাম সাগর ওরফে শুটার নুরু; জেলে রয়েছে টগর।
দেড় যুগ আগে সনির স্মৃতিফলক গড়েছিল বুয়েট প্রশাসন। যাতে লেখা-
"এই আমি খুব আবেগপ্রবণ
এই আমি খুব জেদী
এই আমি খুব ছেলেমানুষ
এই আমি কিছুটা বাস্তব
এই আমি খুব একা।"
এখনও পর্যন্ত বুয়েটের একমাত্র ছাত্রী হলের কোন নাম নেই। দীর্ঘদিন থেকেই বুয়েটের সাধারন শিক্ষার্থীরা ছাত্রী হলের নাম 'সাবেকুন নাহার সনি হল’ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে দাবি জানিয়েছে।অথচ বিষয়টি নিয়ে বুয়েট প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়নি।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!