“সর্বশেষ হলেও মোটেও অমূলক নয়− সত্যি বলতে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- আপনার একটি শুভ সমাপ্তির দরকার। যাই হোক, এই শুভ সমাপ্তির পূর্বে আপনি যদি কিছু ট্র্যাজিক সিচুয়েশন এবং কিছু অশ্রুপাতের অবতারণা করতে পারেন, তা নিতান্ত মন্দ নয়।“ - উক্তিটি মানিকদার, যে নামে তাঁকে তাঁর প্রিয়জনরা ডাকত। এখানে বলা হচ্ছে সবার প্রিয় সত্যজিৎ রায়ের কথা। শুধু বাংলা বা ভারতীয় সিনেমা নয়, বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম এই পথিকৃৎ-এর আজকে একশ একতম জন্মবার্ষিকী। একজন বিশিষ্ট চলিচ্চত্রকার হিসেবে বিশ্বখ্যাত হলেও লেখক, চিত্রশিল্পী এবং আরও বহু কাজে তিনি রেখেছেন তাঁর অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি আজও বহু মানুষের প্রেরণা হয়ে বেঁচে আছেন তাঁর অতুলনীয় সব কর্মের মধ্যে।
কিংবদন্তি এই চলিচ্চত্রকারের জন্ম ১৯২১ এর আজকের দিনে কলকাতায় হলেও পৈতৃক ভিটা তাঁর বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামে। তাঁর পিতা হলেন প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায় এবং পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়। তাই পারিবারিকভাবেই শিল্প-সংস্কৃতি সচেতন পরিবারে বেড়ে ওঠেন তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পড়ার পর পাড়ি জমান শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করার আগেই তিনি ১৯৪৩ এ কলকাতা এসে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারে “জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার” হিসেবে যোগ দেন। কিছুদিন পর ডি কে গুপ্তের প্রকাশনা সংস্থা 'সিগনেট প্রেস'-এর বইয়ের প্রচ্ছদ নকশার কাজে যোগ দেন।
এসবের ফাঁকেই তিনি ১৯৪৭ সালে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন, যার সুবাদে বিখ্যাত সব বিদেশী চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পান। ১৯৫০ সালে ডি জে কিমার সত্যজিৎকে লন্ডনে তাদের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করতে পাঠান। এখানে অবস্থানকালে তিনি প্রায় ৯৯টি চলচ্চিত্র দেখেন। তার মধ্যে ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইতালীয়: Ladri di biciclette, "Bicycle Thieves") তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে অনুপ্রাণিত করে।
নিজের মতো করে মানুষকে রূপালি পর্দায় গল্প শুনানোর বহুদিনের ইচ্ছা এবং আশেপাশের মানুষের উৎসাহ থেকে তিনি ১৯৫২ সালে তাঁর প্রথম ছবি “পথের পাঁচালী”-র নির্মাণকাজ শুরু করেন। অর্থসংকট এবং অন্যান্য প্রতিকূলতার জন্য তিন বছর লেগে যায় সিনেমাটির কাজ শেষ হতে। কিন্তু এত কষ্ট বৃথা যায় নি। ছবিটি মুক্তির পরপরই ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়। জিতে নেয় ১১ টি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার,যার মধ্যে উল্লেখযগ্য ১৯৫৬র কান চলচ্চিত্র উৎসবের “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল”(Best Human Documentary) অন্যতম।
সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমাগুলোতে রেখেছেন বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর। তিনি ছিলেন একাধারে নির্মাতা, পরিচালক, শব্দ প্রযোজক। সবাইকে নিজ হাতে কাজ শিখাতেন। তাঁর তৈরি সিনেমা ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। সমালোচকদের মতে তাঁর মতো স্বতন্ত্র ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের ছবি ভারতে কেউ কখনও তৈরী করেননি। শ্যাম বেনেগাল এর মতে, ‘সত্যজিৎ রায়ই হচ্ছেন একমাত্র ভারতীয় চলচ্চিত্রকার, যিনি ছবি করেছেন ভারতীয় পদ্ধতিতে।’ তাঁর ছবিগুলোর অন্যতম নজরকাড়া দিক হল এর মানবতাবাদ। প্রচলিত ফিল্মের ধারা ও জাঁকজমক থেকে বেরিয়ে তিনি কাজ করতেন সাধারণ মানুষের জীবনের অসাধারণ ও অন্তর্নিহিত ভাবাবেগ নিয়ে।তাঁর সিনেমার বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর দর্শনই তা বলে দেয়− “আমার বিশ্বাস একজন সাধারণ মানুষ− যেমন ধরুণ রাস্তার মানুষের জীবন বিশ্লেষন করা, একজন নায়কের থেকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং একটা বিষয়।“
অপু ট্রিলজি নামে পরিচিত-পথের পাঁচালী(১৯৫৫), অপরাজিত(১৯৫৬) ও অপুর সংসার(১৯৫৯)- তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে বহুল আলোচিত। এই ত্রয়ীতে বিভূতিভূষণ এর গ্রাম বাংলার অপুর সাদামাটা জীবনের অসাধারণ দিককে লেখকের মতোই চমৎকারভাবে পর্দায় তুলে ধরেন তিনি। অপুর সংসারের পরে তিনি দেবী ছবির কাজে হাত দেন। এতে তিনি হিন্দু সমাজের মজ্জাগত কুসংস্কারকে তুলে ধরেন। যার প্রশংসার পাশাপাশি তাই শুনতে হয়েছে রক্ষণশীল হিন্দুদের কঠোর সমালোচনাও।মহানগর সিনেমাতে তিনি তুলে ধরেছেন কিভাবে আমরা জীবিকার কাছে জিম্মি করছি আমাদের মূল্যবোধকে। তাঁর অন্যান্য সফল ছবির মধ্যে রয়েছে চারুলতা, কালপুরুষ, হীরক রাজার দেশে, অশনি সংকেত, চিড়িয়াখানা। এছাড়াও অন্যতম জনপ্রিয় কাজ হল তাঁর পিতামহ উপেন্দ্রকিশোরের সম্মানে তাঁর লিখা গল্পের ভিত্তিতে ছোটদের জন্য নির্মিত “গুপী গাইন বাঘা বাইন”।
সত্যজিতের সিনেমার আলাদা হয়ে উঠার পিছনে বড় কারণ তাঁর কাস্টিং এর নৈপুণ্য। তিনি সমসাময়িক জনপ্রিয় তারকাদের পিছে ছবিতে কাজ করার জন্য ছুটতেন না। এর পিছনে আর্থিক সীমাবদ্ধতার চেয়ে বড় কারণ ছিল তিনি তাঁর চরিত্রগুলোকে জীবন্ত দেখতে আগ্রহী ছিলেন। অভিনয়ের দক্ষতা দিয়ে নয়, বরং স্বভাবগতভাবেই যারা সেই চরিত্রকে লালন করে, তাদেরকেই খুঁজে নিতেন। এর ফলে তাঁর ছবিগুলো ব্যবসায়িকভাবে সেরকম সফল না হলেও চরিত্র ও চিত্রনাট্যের শৈলীতে অনন্য হয়ে উঠত। তিনি ছবির গল্প নিয়ে কখনও আপোষ করতেন না(গল্প নিয়ে আপোষ করেননি কখনও)। তাঁর কাস্টিং নিয়ে এই সাবধানী স্বভাবের অন্যতম সাক্ষী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দুইজনের সুন্দর বোঝাপড়া এবং সত্যজিতের সৌমিত্রের জন্য ভালো লাগা- কোনোটাই তাঁর “গুপী গাইন ও বাঘা বাইন”-এ কাজ করার অনুরোধ এর জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাঁর মতে, সৌমিত্রর শহুরে চেহারা এই সিনেমার জন্য একদমই মানানসই ছিল না। বেশ কিছু ছবির বেলায় কেবলমাত্র চরিত্রের সাথে মিল আছে এমন কাউকে না পাওয়ায় তিনি ছবি বানাননি। তবে প্রয়োজনে যে তিনি তারকাদের সাথে কাজ করেননি একেবারে তাও সত্য নয়। “নায়ক” ছবিতে সুপারস্টার দরকার হওয়ায় তিনি ছুটে গিয়েছেন উত্তম কুমারের কাছে। তবে কিছু নীতি যেমন- মেকআপ ছাড়া পর্দার সামনে আসা, চিত্রনাট্যে গল্পকে ও চরিত্রকে প্রাধান্য দেওয়া- এসবে তিনি সবসময় অটল ছিলেন। তাই তো সুচিত্রা সেনের মতো তারকা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি হলেও অন্য ছবির সাথে চুক্তি স্থগিত না করায় তিনি “দেবী চৌধুরানী” তৈরী করেননি।
চলচ্চিত্রে সত্যজিতের জনপ্রিয়তা এতই বেশি যে লেখক হিসেবেও যে তিনি সমান প্রতিভাবান ছিলেন, সেটা অনেকেই মাঝে মাঝে ভুলে যায়। তাঁর লিখা ফেলুদা বা প্রফেসর শঙ্কু পড়েনি এমন বই পড়ুয়া খুঁজে পাওয়া ভার।বাংলা সাহিত্যে অনেক গোয়েন্দা চরিত্রের আবির্ভাব হয়েছে।কিন্তু ফেলুদার মত এত জনপ্রিয় আর প্রভাদবিস্তারকারী চরিত্র মেলা ভার।একটা প্রজন্মের কৈশোরের মধুর সময় কেটেছে ফেলুদা ও তোপসের রোমহর্ষক গল্প পড়ে,আর এই ধারা এখনকার বইপ্রেমিকদের মাঝে সমানভাবে অব্যহত আছে। ফেলুদা, তার সহকারী খুড়তুতো ভাই তপেশচন্দ্র মিত্র ওরফে তোপসে এবং পরবর্তীতে বেশ কিছু অভিযানের নিয়মিত সঙ্গী লালমোহন গাঙ্গুলী এদের পাঠকসমাজে জনপ্রিয়তা এতই বেশি যে, বর্তমানের গোয়েন্দা কাহিনীগুলোর চরিত্রগুলোকে তাদের সাথে তুলনা করা হয়। প্রফেসর শঙ্কুর মজার সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নিয়ে লেখা কল্পকাহিনী গুলো সায়েন্স ফিকশনে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মানেই যে ভাবগম্ভীর বিজ্ঞানভিত্তিক কথার মালা নয়, এই সিরিজ তার অন্যতম উদাহরণ। তাঁর লেখা বইগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল,তিনি নিজেই বইয়ের মাঝে মাঝে ছবি এঁকেছেন যা কাহিনীগুলোকে আরও চমকপ্রদভাবে পাঠকদের কাছে তুলে ধরে।এই দুটি বিখ্যাত সিরিজ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু গল্প, স্মৃতিকথা এবং চলচ্চিত্র নিয়ে বই লিখেছেন। এর মধ্যে “যখন ছোট ছিলাম”, “একের পিঠে দুই”, “একেই বলে শুটিং” এবং আরেক জনপ্রিয় চরিত্র তারিণীখুড়োর গল্পসমূহ অন্যতম।
সত্যজিত রায়ের লিখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর ছোটখাটো বিষয় ও ঘটনাস্থল বর্নণার নিখুঁত কৌশল।বেশিরভাগ লেখায় উল্লেখিত স্থানগুলো তিনি তাঁর সাম্প্রতিক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকেই তুলে ধরেছেন।তাই তাঁর বই গুলোকে গোয়েন্দা কাহিনী বা সায়েন্স ফিকশনের বদলে ভ্রমণ কাহিনী বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়। যেন তিনি তাঁর লিখার মধ্যেও সিনেমার মতো পুরো দৃশ্যটি তুলে ধরেন। সৌমিত্র চট্রোপ্যাধায় তো একবার মজা করে বলেইছিলেন যে, গ্যাংটকে গন্ডগোল, দার্জিলিং জমজমাটে যত নিখুঁতভাবে গ্যাংটক কিংবা দার্জিলিংয়ের বর্ণনা দেওয়া আছে, তা বোধহয় সিকিম ট্যুরিজমের কিংবা এই রাজ্যের ওয়েবসাইটেও নাই।
সিনেমা জগতের কালজয়ী এই নির্মাতা তাঁর জীবদ্দশায় প্রচুর পুরষ্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সবচেয়ে বিখ্যাত অর্জন হল ১৯৯২ সালে প্রাপ্ত একাডেমি সম্মানসূচক পুরষ্কার (অস্কার)। এছাড়াও তিনি ৩২ টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার, ভারতরত্ন, পদ্মভূষণ এবং চার্লি চ্যাপলিনের পরে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে চলচ্চিত্রে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। ২০০৪ সালে তিনি বিবিসির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের তালিকায় ১৩তম স্থানে তালিকাভুক্ত হন।বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই ব্যক্তিত্ত্ব ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সত্যজিত রায়,যিনি মার্টিন স্করসেজ, ওয়েজ এ্যান্ডারসন,জেমস আইভরির মত বিশ্ববরেণ্য চলচিত্রকারসহ অতীত-বর্তমানের অনেক চলচ্চিত্রকারের অনুপ্রেরণা,বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই তাঁর কাজগুলো অজানা।বা কিছু কাজের সাথে পরিচয় থাকলেও তিনি বিশ্বদরবারে বাংলা সিনেমাকে যে মর্যাদার স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন তার ব্যাপারে ধারণা নিতান্তই কম।তিনি যে তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়েছিলেন তা তাঁর কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়।তাই সাদাকালো হলেও জীবনবোধ এবং নির্মাণকৌশলে অনেক বেশি সমৃদ্ধ তাঁর সিনেমাগুলো।আজ উপমহাদেশের সিনেমাজগৎ তাই একজন সত্যজিত রায়ের শূণ্যতা অনেক বেশি করে অনুভব করে।
তথ্যসূত্র:উইকিপিডিয়া,দ্যা ডেইলি স্টার
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!