উনবিংশ শতাব্দিতে স্যোশালিজমের প্রতি ভীষণ ঝুঁকে পরে শ্রমিক সমাজ। ১৮৮৪ সালেই আমেরিকার শ্রমিক ফেডারেশন আট ঘণ্টা কর্ম দিবসের দাবি জানায়। কিন্তু ক্যাপিটালিস্ট গোষ্ঠী কোনো সাড়া না দিলে ১৮৮৬ সালে দৈনিক আটঘন্টার কাজের দাবীতে আমোরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলীবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়।
১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবার্র্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক-এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এরপরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘন্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবী আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহবান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না খাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে’র ১ তারিখে “বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার” সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসের ১ তারিখকে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে পালনের দাবী জানায় এবং অনেক দেশেই এটা কার্যকরী হয়। দীর্ঘদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিষ্ট এবং কিছু উগ্রবাদী সংগঠন তাদের দাবী জানানোর জন্য মে দিবসকে মুখ্য দিন হিসাবে বেছে নেয়। কোন কোন স্থানে শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে আগুনও জ্বালানো হয়ে থাকে। পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চীন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সে সব দেশে এমনকি এ উপলক্ষ্যে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতেও এই দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে।
কিন্তু শ্রমিকের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের যে ইতিহাস আমরা জানি সেটি ছাড়াও এই মে দিবসের আছে অজানা অনেকে তাৎপর্য। মে দিবসের ইতিহাস তলিয়ে দেখতে গিয়ে ইতিহাসবিদ হেলেন কার খুঁজে পেলেন রোমান সাম্রাজ্যে এর উৎপত্তি যা ছিল প্রধানত প্যাগানদের একটি বাৎসরিক উৎসব। সেই সময় মে দিবস অর্থাৎ মে মাসের ১ তারিখে শীতের শেষে বসন্তের আগমন ও প্রকৃতির পুনর্জাগরণ উপলক্ষে হাজার বছর আগে নাচ-গানের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হতো। ধারণা করা হয় এর উৎপত্তি রোমান দেবী ফ্লোরা (Flora) এর পুজা থেকে আসা উৎসব ফ্লোরালিয়া (Floralia), যা ছিল মে মাসের পুরোটা জুড়ে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য নিবেদিত। ঋতুর এই আশীর্বাদসুচক পরিবর্তনের প্রতীক ছিল "আগুন" অর্থাৎ শীতের মৃত্যু এবং নতুন জীবনের সূচনা (আদিম কালেও একেকটি শীতকাল পার করতে পারলে গুহাবাসী আগুন জ্বালিয়ে উদযাপন করত এবং এখান থেকেই জন্মদিনের কেকের উপর মোমবাতি জ্বালানোর প্রচলনটি আসে)।
আবার ১৫১৭ সালে লন্ডনে প্লেগের ছড়াছড়ি ও এক বছরের খরার পর সাধারণ মানুষের জন্য জীবন দুর্বিষহ সাধারণ ইংরেজ জনতা হঠাৎ করেই ফুঁসে উঠলো। তাদের রাগ গিয়ে পড়ল প্রবাসীদের উপর। ঐ বছর ১ মে প্রায় ২০০০ লন্ডনের অধিবাসী রায়টে অংশগ্রহণ করে এবং রাস্তায় নেমে প্রবাসীদের বাড়িতে গিয়ে হামলা শুরু করে। আজও এই দিনটিকে Evil May Day বলা হয়।
পহেলা মে কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে উদযাপন করা হলেও শ্রমিকের অধিকার আদায় হয়নি দীর্ঘদিন পর্যন্ত। ১৯৫২ সালে জাপানে এই মে দিবসের রূপ ছিল একেবারে অন্যরকম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে কালোবাজারের ছড়াছড়ি, গ্যাংস্টার ও ক্রিমিনালের দৌরাত্ম্য এবং ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক শোষন নিয়মিত হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৪৭ সালে কম্যুনিস্ট পার্টির পুনরুত্থানের পর ধর্মঘট লেগে থাকলেও ১৯৫২ সালের ১ মে টোকিওতে Imperial Palace এর সামনে করা ধর্মঘট ভয়ানক চেহারা ধারণ করে পুলিশের আক্রমণে। বিশ্ববাসীর কাছে Bloody May Day নামে পরিচিত এই দিনে পুলিশের হাতে একজন মারা যায় এবং আরও অনেকে আহত হয়ে মারা যায় কিছুদিন পর। এই দিনের পর জাপানে টিয়ারগ্যাসের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!