"সত্যে, সাম্যে, একতায়"

বুয়েটে প্রকৌশলবিদ্যায় নারীঃঅতীত ও বর্তমান






বাংলাদেশে প্রকৌশলবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা লাভে আগ্রহীদের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা বুয়েট অন্যতম প্রধান আকর্ষনীয় প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছরই হাজার হাজার ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা বুয়েটের অ্যাডমিশন টেস্টে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে এখানে পড়ার সুযোগ লাভ করে। বর্তমানে ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই সমানভাবে ভর্তির সুযোগ পেলেও প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এমন ছিল না।


১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ১৯৪৭ সালে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে উন্নীত হয়। এরপর ১৯৬২ সালে তা East Pakistan University of Engineering and Technology (EPUET) হিসেবে যাত্রা আরম্ভ করে। স্বাধীনতার পরবর্তিতে এই EPUET-ই বুয়েট বা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নাম লাভ করে।


প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বুয়েটের এমন কোন লিখিত নিয়ম ছিল না যে এখানে মেয়েরা ভর্তি হতে পারবে না। এমনকি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্থাপত্যবিদ্যার প্রথম ব্যাচে (১৯৬১-১৯৬৬) তিনজন মেয়ে শিক্ষার্থী ছিলেন যারা হলেন নাজমা আনোয়ার,ওয়াসিফা রহমান এবং শাহীন বাহার চৌধুরী। কিন্তু অন্যান্য অনুষদে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তির বিরুদ্ধে ছিলেন বুয়েটের প্রথম এবং তৎকালীন উপাচার্য এম. এ রশীদ। তৎকালীন কর্তৃপক্ষের মতে তৎকালীন সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী মেয়েদের প্রকৌশলবিদ্যায় উচ্চশিক্ষা লাভের অনুকূলে ছিল না। প্রধানত পূরকৌশল তথা সিভিল ডিপার্টমেন্টে এক মাসের সার্ভের জন্য বাইরে থাকতে হয়,যা মেয়েদের জন্য অনুপোযুক্ত বলে মনে করে তখনকার কর্তৃপক্ষ। তাই মেয়েদের ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।


কিন্তু এসব বাধাকে উপেক্ষা করে নিজেদের প্রকৌশলবিদ্যায় পড়ার স্বপ্নকে পূর্ণরূপ দিতে উদ্যোগ নেন তিন অদম্য নারী। তারা হলেন খালেদা শাহরিয়ার কবির (ডোরা), মনোয়ারা বেগম এবং শিরিন সুলতানা (চুমকি)। তারা কর্তৃপক্ষের কাছে বুয়েটে মেয়েরা পড়তে পারবে না এমন কোনো নিয়ম আছে কিনা জানতে চান এবং যখন দেখা যায় এমন কোনো নিয়ম নেই,তারা অনুরোধ করেন তাদের ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দেওয়ার জন্য। শুরুতে রাজি না হলেও তাদের অধ্যবসায়ের কাছে হার মানে কর্তৃপক্ষ। তারা নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করে ভর্তির সুযোগ পান। কিন্তু বিনা শর্তে নয়। তারা কেউ পূরকৌশলে ভর্তি হতে পারবেন না এই শর্তে রাজি হতে হয় তাদের। শুরুতে খালেদা শাহরিয়ার কবির (ডোরা) এবং শিরিন সুলতানা (চুমকি) ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলেও তারা পরে আবার প্রশাসনের সাথে লড়াই করে তাদের থেকে অনুমতি লাভ করেন পূরকৌশলে ভর্তি হবার।আর মনোয়ারা বেগম কেমিকৌশলে তার পড়াশুনা চালিয়ে যান।


এভাবেই বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ারিং এ ছাত্রীদের পদচারণার অগ্রদূত হিসেবে খ্যাত হন এই তিন বান্ধবী। তবে এই ইতিহাস সময়ের সাথে ডালপালা যুক্ত হয়েছে, যোগ হয়েছে অনেক গুজব। সেরকমই একটি বহুল প্রচলিত বুলি হলো- তারা তিনজন বুয়েটের সাথে আইনি লড়াই করে মেয়েদের ভর্তির পথ তৈরি করেন। যেটির সম্পর্কে স্বয়ং খালেদা শাহরিয়ার কবির বলেছেন, “আইনি পদক্ষেপের কথাটি সত্য নয়। আমরা বুয়েটের বিরুদ্ধে কখনোই মামলা করিনি, কারণ তার দরকার পড়ে নি। আমরা আশাবাদী ছিলাম যুক্তিতর্কের মাধ্যমে প্রশাসনের মত পরিবর্তন করতে পারব এবং আমরা সফল হই।“ তৎকালীন সামাজিক কটুদৃষ্টিকে উপেক্ষা এবং কর্তৃপক্ষের সাথে যে অদম্য লড়াই করে তারা প্রকৌশলবিদ্যায় পড়ার সু্যোগ পান, যার ফল সেইসময়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রকৌশলবিদ্যা পড়তে আগ্রহী সকল মেয়ে ভোগ করছে,তার কোনো তুলনা হয় না।


প্রতিষ্ঠার পর কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে। এখন ছেলেমেয়ে সকলেই কোনরকম এ্কাডেমিক বৈষম্য ছাড়া এখানে পড়াশুনার সু্যোগ পাচ্ছে। এ্কাডেমিক দিক থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ কোন দিক দিয়েই কোনরকম লিঙ্গবৈষম্যের কথা কখনো শোনা যায়নি। অনেক নারী শিক্ষক রয়েছেন যারা এখানে দক্ষতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য হলেন প্রফেসর খালেদা একরাম, যিনি বুয়েটের প্রথম নারী উপাচার্য এবং অন্যতম সফল ভিসি হিসেবে নিজের কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।


বুয়েটের আর্কিটেকচার অনুষদের প্রথম ব্যাচের(১৯৬১-৬৬) খন্ডাংশ।

বুয়েটের আর্কিটেকচার অনুষদের প্রথম ব্যাচের(১৯৬১-৬৬) খন্ডাংশ।


কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেবলমাত্র তার এ্কাডেমিক দিকের দায়িত্ব নিপুনভাবে পালন করেলেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বুয়েটে এখনও বেশ কিছু দিক রয়েছে যার দিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেওয়া বেশ জরুরি।


শুরুতেই বলতে হবে এ্কাডেমিক ভবনগুলোর ওয়াশরুমগুলোর কথা। বেশিরভাগ ওয়াশরুমেই নেই পর্যাপ্ত হ্যান্ডওয়াশের ব্যবস্থা। এটা অনেক দুঃখজনক ব্যাপার যে,ওয়াশরুমগুলো পিরিয়ডবান্ধব নয়। ইমারজেন্সি স্যানিটারি ন্যাপকিনের কোন ব্যবস্থাই নেই। যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াদের দিনের বড় একটা সময় এ্কাডেমিক ভবনেই কাটাতে হয়,সেখানে পিরিয়ডবান্ধব ওয়াশরুম না থাকাটা অনেক বেশি দুঃখজনক। উপরন্তু মেকানিক্যাল ভবনে নেই মেয়েদের জন্য আলাদা ওয়াশরুম। সেখানে মেয়েদের অন্যতলায় আইপিই-র ওয়াশরুম ব্যবহার করতে হয়,যা মূলত তাদের কমনরুমের ওয়াশরুম।


এরপর আসা যাক আবাসিক সমস্যাগুলোয়। একদম শুরুর দিকে বুয়েটের ছিল না কোন ছাত্রীহল। প্রথম তিন মেয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে। এরপর ছাত্রীদের আবাসনের জন্য প্রতিষ্ঠা হয় হল,যা ছাত্রীহল নামেই পরিচিত। মেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার সাথে তাল মিলাতে তৈরি হয়েছে নতুন আর একটি হল, যা উদ্বোধন হলে ছাত্রীদের আবাসনসংকট মিটে যাব বলেই আশা করা হচ্ছে। কিন্তু এছাড়া কিছু সমস্যা রয়েছে যা ছাত্রীহলবাসীদের হরহামেশাই ভুগতে হয়। ডাইনিংব্যবস্থায় রয়েছে প্রচুর উন্নতির সুযোগ।আর রান্নার সু্যোগ নেই ছাত্রীদের জন্য,উপরন্তু ২৪ ঘণ্টা খোলা এমন কোন ক্যান্টিনও নেই। সকাল আর বিকালে যে অস্থায়ী ক্যান্টিন বসে তার খাবারের মান, মূল্য,ব্যবহার নিয়ে বারবার অভিযোগ করেও কোন ফল পাওয়া যায় নি।নন-রেসিডেন্ট মেয়েদের অনেক ইমারজেন্সিতেও হলে রাত থাকতে দেওয়া হয় না,উপরন্তু তারা অনেকেই বেশ বাজে ব্যবহারের শিকার হয়েছে


বাংলাদেশের স্বাভাবিক সামাজিক দৃষ্টিভংগিতে এখনো মেয়েদের প্রকৌশলবিদ্যায় পড়া নরমালাইজড নয়।তাই স্বাভাবিকভাবেই এখানে মেয়েদের সংখ্যা কম ছেলেদের তুলনায়।বুয়েট সেই সমাজের বাইরে নয়।তাই এখানে সবধরনের চিন্তাধারার মানুষই আছে। খুব কম হলেও মেয়েদের যথেষ্ট যোগ্য না ভাবা,তাদের ছোট করার মত ব্যাপার একেবারে বিরল নয়।কিন্তু সার্বিকভাবে বলতে গেলে পরিবেশ এখানে অনেক বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং মেয়েদের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ।


বুয়েটে মেয়েদের ভর্তির সুযোগ সৃষ্টিতে অগ্রদূত তিন নারী,(বাম থেকে ডানে): শিরিন সুলতানা (চুমকি), মনোয়ারা বেগম, খালেদা শাহরিয়ার কবির (ডোরা)।

বুয়েটে মেয়েদের ভর্তির সুযোগ সৃষ্টিতে অগ্রদূত তিন নারী,(বাম থেকে ডানে): শিরিন সুলতানা (চুমকি), মনোয়ারা বেগম, খালেদা শাহরিয়ার কবির (ডোরা)।


“একজন মেয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে বুয়েটে অভিজ্ঞতা কেমন?”- এই প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইইই’১৮ এর একজন শিক্ষার্থী বলেন,” একজন মেয়ে প্রকৌশল শিক্ষার্থী হিসাবে বুয়েটে আমার সার্বিকভাবে অভিজ্ঞতা খারাপ না। টিচাররা কখনো মেয়ে হিসাবে আলাদাভাবে মূল্যায়ণ করেননি। ছাত্রীহলে কিছু অদ্ভুত নিয়ম আছে, অনাবাসিকরা রাতে এমারজেন্সিতেও থাকতে পারেনি, অন্যান্য ব্যবস্থা করতে হয়েছে। ক্লাসমেটরাও অনেক হেল্পফুল। কিন্তু দুই একজন তো থাকেই,সবজায়গাতেই,যারা বাউন্ডারি বোঝে না,আবার অনেকে মেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াটা মানতে পারে না। তার জন্য কিছু অপ্রীতিকর সিচুয়েশনের সম্মুখীন হতে হয়েছে।“ আবার মেকানিক্যাল’১৭ এর আফিফা বিনতে ইসলাম এর মতে,”অ্যাকাডেমিক ভাবে বুয়েট একদম নিরপেক্ষ একটা প্রতিষ্ঠান। পড়াশুনার দিক থেকে ছেলে মেয়ে কোনো বৈষম্য আজ পর্যন্ত আমার নজরে আসেনি আর ভবিষ্যতেও আসবে বলে একদম ই মনে করিনা। ইঞ্জিনিয়ারিং এ মেয়েরা এখনো একটু কমই ভর্তি হয়, হয়তো সেকারণে বুয়েট ছেলে মেয়ের অনুপাত একটু চোখে পড়ে। কিন্তু সেটা আমার তিন বছরের ভার্সিটি লাইফে কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় নি। কোনোভাবেই না। মানসিক দিক দিয়ে যদি বলি, আমার ক্যাম্পাস আমার সব থেকে বেশি সেইফ লাগে। বাসায় যেমন মনে হয় যে, এটা আমার নিজের জায়গা। বুয়েট ক্যাম্পাসটা একদম তাই লাগে। ১-১ এ থাকা অবস্থায় আমাদের ডিপার্টমেন্ট ফেস্ট এর সময় স্ট্রীট পেইন্টিং এর জন্য সারারাত ক্যাম্পাসে ছিলাম। আমার একটা বার এক মুহুর্তের জন্যও নিজেকে আনসেইফ লাগে নি।বুয়েট কে সেইদিন সব থেকে বেশি সুন্দর মনে হয়েছিল।কনসার্টের রাতে মেয়েরা যেভাবে নির্ভয়ে থাকতে পারে, এটা মনে হয়না বাংলাদেশের অন্য কোথাও সম্ভব। ওইদিন টাতেও আমার নিজের ক্যাম্পাস নিয়ে গর্ব হয়।”


সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, বুয়েট ছেলেমেয়ে সকলকেই এ্কাডেমিক দিক দিয়ে সমান সুযোগ প্রদান করলেও, আরও বেশ কিছু আনুষাঙ্গিক ক্ষেত্র রয়েছে,যেসব দিকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিপ্রদান করা বেশ জরুরি। শুরুর দিকে এখানে মেয়েরা পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও,আজ সবাই সমানভাবে এর দাবিদার, সমানভাবে এখানে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছে। তাই এটা আশা করা অমূলক নয়, যে এসব সমস্যাও একসময় দূরীভূত হবে।সেই সময় যত দ্রুত আসবে, সকলের জন্য তা ততই মঙ্গলজনক হবে।


তথ্যসূত্র: The Business Standard, Context, Wikipedia, BUET website


মন্তব্য করতে লগিন করুন
লগিন
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!
সম্পর্কিত
এখন থেকে বুয়েটে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সকল ধরণের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য রক্ষা, শিক্ষার মান … বিস্তারিত


আবরারের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না? এই প্রশ্নে রুল জারি

গত ৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার … বিস্তারিত


রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বুয়েট এর নতুন ভিসি এবং প্রোভিসি নিয়োগপ্রাপ্তি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভিসি পদে নিয়োগ পেয়েছেন অধ্যাপক ড. … বিস্তারিত



বুয়েটে চলামান টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত করেছে একাডেমিক কাউনসিল, এবং শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করে দ্রুততম সময়ে পরীক্ষা রিশিডিউল ও যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন

বুয়েটে চলামান টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত করেছে একাডেমিক কাউনসিল, এবং … বিস্তারিত