'কুরবান' শব্দটি ফারসিতে 'কুরবানি' হিসেবে পরিচিত যার মূল অর্থ 'নৈকট্য'। কুরবানির ইতিহাস খুঁজতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে একদম মানবসভ্যতার শুরুতে। আল্লাহর আদেশে যেদিন থেকে আদি পিতামাতা আদম(আ) ও হাওয়া(আ) এই ভূপৃষ্ঠে পদার্পণ করেন সেদিন থেকেই কুরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কুরবানির প্রথম ঘটনা আমরা জানতে পারি নবি আদম(আ) এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল এর ঘটনা থেকে। তবে আধুনিক পশু জবেহের মাধ্যমে কুরবানি পালনের শুরু হয়েছে এক হৃদয়বিদারক কিন্তু ঈমানদীপ্ত ঘটনা থেকে।
আল্লাহ তার অন্যতম প্রিয় বান্দা নবি ইব্রাহিম(আ) কে স্বপ্নে আদেশ দেন যেন তিনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করেন। অনেক ভেবেচিন্তে নবি ইব্রাহিম(আ) বুঝতে পারলেন তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় হলেন তাঁর পুত্র ঈসমাইল(আ)। পিতা ইব্রাহিম(আ) এই সময় কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হলে, একদিকে পুত্রের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা অন্যদিকে স্রষ্টার প্রতি তাঁর অসীম আনুগত্য। তিনি পুত্রকে গিয়ে বিষয়টি জানালেন, পুত্র বিনা সংকোচে বলে দেন যে, তিনি (ঈসমাইল) আল্লাহর রাস্তায় জীবন কুরবান করাকে অধিক পছন্দ করবেন। যথারীতি কুরবানির স্থানে পৌঁছে ইব্রাহিম(আ) ঈসমাইল(আ) এর গলায় ছুরি চালাতে উদ্যত হলে সেখানে ঈসমাইল(আ) এর জায়গায় অলৌকিকভাবে একটি দুম্বা কুরবানি হয়ে যায়। এত কঠিন কাজ হওয়া সত্ত্বেও পিতা-পুত্রের আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে খুশি হয়ে আল্লাহ ঈসমাইল(আ) কে বাঁচিয়ে দেন এবং তাঁদের এই ঘটনা কিয়ামত পর্যন্ত দৃষ্টান্ত বানিয়ে রাখতে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নির্ধারিত দিনে পশু জবেহের মাধ্যমে কুরবানি করার বিধান চালু করেন।
প্রতিবছর কুরবানির পশু জবেহ করার সময় আমরা আল্লাহর প্রতি ইব্রাহিম ও ইসমাঈল আলাইহিমুসসালাম এর আনুগত্যের কথা স্মরণ করি এবং প্রয়োজনে আমরাও এরকম কঠিন আনুগত্য দেখাতে পারব তা অন্তরে ধারণ করি। আল্লাহর জন্য উৎসর্গকৃত পশুর মাংস, চামড়া, রক্ত কিছুই আল্লাহ গ্রহণ করেন না, আল্লাহর এসবের প্রয়োজন ও নেই। তিনি শুধু তাঁর বান্দাদের তাকওয়া (আল্লাহভীতি বা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য) পরীক্ষার জন্য এই কুরবানির আদেশ দিয়েছেন।
তিনি ইরশাদ করেন, “আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না সেগুলোর গোশত এবং রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।" (সূরা হাজ্জ, ৩৭) কুরবানি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে সাধারণত গরু, ছাগল কুরবানি করা হয়ে থাকে। গরু ও ছাগলের প্রতি কেজি মাংসের বাজারমূল্য অনেক বেশি যা দরিদ্র তো বটেই অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্যও ক্রয় করা দুঃসাধ্য। কিন্তু, কুরবানির এই মৌসুমে সবাই কুরবানিকৃত গরু, ছাগলের মাংস গরীব, মিসকিন ও আত্মীয় স্বজনদের মাঝে বিলি, বিতরণ করে। ফলে বছরের এই সময়টায় সবাই উৎসবমুখর পরিবেশে মাংস খেতে পারে। এছাড়াও প্রতিবছর কুরবানির জন্য গবাদিপশু লালন পালন করে অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে যাদের সারা বছরের আয় এই উৎসবের উপর নির্ভরশীল। পশুর বাজার, পরিবহন, পশুর খাদ্য ও পরিচর্যা, জবেহ থেকে মাংস প্রসেসিং, দেশের চামড়া শিল্পের বৃহৎ জোগানসহ অর্থনীতির অনেক কিছুই এই উৎসবের সাথে জড়িত।
কোনো ব্যক্তির কাছে যদি জিলহজ্জ মাসের ১০,১১ ও ১২ তারিখ নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে তবে তার জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব। পশুর নির্বাচন-
১) গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এ পশুগুলো দ্বারা কুরবানি করা যাবে। ২) একটি উট, গরু বা মহিষে ৭ জন পর্যন্ত শরীক হতে পারবে। একটি দুম্বা, ছাগল, ভেড়া শুধু একজনই দিতে পারবে।
৩) উটের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর, গরু ও মহিষের কমপক্ষে ২ বছর ও ছাগল, ভেড়া, দুম্বার ক্ষেত্রে বয়স কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। তবে ৬ মাস বয়সের ছাগল/ভেড়া দেখতে ১ বছরের মত হৃষ্টপুষ্ট হলে কুরবনি বৈধ হবে।
৪) পশু ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। অন্ধ, খোঁড়া, লেজ বা কান কাটা, রোগে চর্বি বা মজ্জা নষ্ট হয়ে গিয়েছে এরকম পশু কুরবানির উপযোগী নয়। উল্লেখ্য, কুরবানির জন্য কিনে আনা পশু কুরবানি চাড়া অন্য কোনো কাজে (মাংস বিক্রি, দুধ খাওয়া, লড়াই লাগানো, কৃষিকাজে ইত্যাদি) ব্যবহার করা যাবে না।
জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ সকালে সবার আগে ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে। ঈদের নামাজ আদায়ের পর কুরবানি করতে হবে। অনেকে ঈদের নামাজ আদায় না করে শুধু কুরবানি করেন যা সঠিক নয়। ঈদের নামাজ সুন্নত নয়, বরং ওয়াজিব এবং তা আদায় করা বাধ্যতামূলক। নামাজ আদায়ের পর পশুকে কুরবানির জন্য নির্ধারিত স্থানে আনতে হবে। এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেন পশুকে শোয়ানোর সময় কম ব্যাথা পায় এবং শোয়ানোর সময় পশুকে প্রহার করা, ব্যাথা দেয়া যাবে না। জবেহ করার আগে পশুকে কিবলামুখী করে শোয়াতে হবে এবং কুরবানিদাতার নিয়্যত বিশুদ্ধ করতে হবে। গোশত খাওয়া বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কুরবানি করলে কুরবানি বাতিল হয়ে যাবে। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়্যত করে কুরবানিদাতা নিজের পশু নিজেই জবেহ করবে। যদি নিজে জবেহ করতে না পারে তবে অন্য কাউকে দিয়ে জবেহ করানো যাবে। তবে নিজে জবেহ করা উত্তম। জবেহের পূর্বে ছুরি যথাসম্ভব ধার করে নিতে হবে যেন পশুর খুবই কম কষ্ট হয়। জবেহের সময় 'বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার' অবশ্যই বলতে হবে অন্যথায় জবেহকৃত পশুর মাংস হারাম হয়ে যাবে। দ্রুত জবেহ করতে হবে এবং ঘাড় বা গলার ৪টি রগ বা নালীর মধ্যে খাদ্যনালী, শ্বাসনালী ও পার্শ্বস্থ দুইটি শিরা কেটে দিতে হবে। স্পাইনাল কর্ড কাটা যাবে না, কাটলে কুরবানি হয়েছে বলে গণ্য হবে না। স্পাইনাল কর্ড এর মাধ্যমে পশুর শরীরের সাথে মস্তিষ্ক যুক্ত থাকে, ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই পশুর শরীর থেকে প্রায় সমস্ত রক্ত ও রক্তের জীবাণু বের হয়ে যায় এবং পশু দ্রুত মারা যায়। অন্যদিকে সম্পূর্ণ শিরশ্ছেদ করা হলে মস্তিষ্ক থেকে দেহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, রক্ত দেহের অভ্যন্তরেই থেকে যায়, যা মাংসকে দূষিত করে এবং পশুর মৃত্যুবরণ করতেও অনেক কষ্ট হয়।
অনেক সময় তাড়াতাড়ি মারা যাওয়ার জন্য পশুর পায়ের রগ কেটে দেয়া হয় বা স্পাইনাল কর্ডে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয় যার ফলে কুরবানি শুদ্ধ হয় না। জবেহের পর দুই/তিন মিনিট যতক্ষণ না সম্পূর্ণরুপে পশুটি মারা যাচ্ছে ততক্ষণ চামড়া ছাড়ানো বা রগ কাটা একদমই নিষিদ্ধ।
একাধিক শরীক থাকলে কুরবানির পশুর মাংস শরীকরা ওজন করে ভাগ করে নিবে। মাংস ৩ ভাগ করা মুস্তাহাব। এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের উপহার হিসেবে দেয়ার জন্য এবং এক ভাগ গরীব, মিসকিনদের দান করে দেয়ার জন্য। কুরবানির পশুর মাংস মুসলিম, অমুসলিম সকলেই দেয়া যায় ও সকলেই খেতে পারে।
কেউ যদি জিলহজ্জের ১০ তারিখ কুরবানি করতে না পারে, সে চাইলে ১১ বা ১২ তারিখেও কুরবানি করতে পারবে। কিন্তু ঈদুল আজহার ওয়াজিব নামাজ শুধু ১০ তারিখেই পড়া হয়।
কুরবানির পশু কিনতে যাওয়া, এনে খাওয়ানো, পশুর মাংস পরিবহন, গরীবদের মাঝে বিলানো ইত্যাদি নিয়ে আমাদের দেশে প্রতিবছর সপ্তাহব্যাপী দিন ব্যাপী আনন্দ উৎসব চলে, যা শতশত বছর ধরে বাঙ্গালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদ পালন করুন। আল্লাহ সকলের কুরবানি কবুল করুক ও সবাইকে গরীব দুঃখীদের মাঝে দান করার তাওফিক দান করুক। আমিন।
বুয়েট সাংবাদিক সমিতির পক্ষ থেকে সবাইকে ঈদুল আযহার শুভেচ্ছা। ঈদ মুবারক।
সহায়ক-
[১]- আল কুরআন (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ১০০-১১১) [২]- সহিহ মুসলিম [৩]- আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ) [৪]- কুরবানির ইতিহাস, উদ্দেশ্য ও কতিপয় বিধান (ড. আব্দুল কাদের)
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!