বেশিদিন না, এইতো এক বছরের একটু বেশি আগেই, বুয়েট ছিলো অন্যরকম এক সাম্রাজ্য। অন্য সব সাম্রাজ্যের মতো বুয়েটের ছিলো নিজস্ব সংস্কৃতি এবং প্রবহমান চিন্তাধারা। তবে সেই সাম্রাজ্যের ছিলো দু'টো রূপ। মুখোশের আড়ালে ছিলো কিছু ক্ষমতালোভী অযাচিত প্রাণী। অনেকে হয়তো মশকরা ভাববে, "এরা তো সবাই বুদ্ধিমান, এরা তো সবাই ব্রিলিয়ান্ট, এদের আবার কিসের লোভ?"
আশেপাশের মানুষ যখন মুখোশের সদা শুভ্রতায় ব্যাকুল, ঠিক তখনই বুয়েটে নেমে আসে এক কালো রাত। ৭ই অক্টোবর রাত। ছেলেটার নাম আবরার। সেদিন বিকেলেই কেবল মায়ের ছায়া ছেড়ে বুয়েটে আসে বড় ছেলে আবরার। সে হয়তো তখন ভাবছিলো, "পরীক্ষাটা দিয়েই আবার বাসায় গিয়ে মায়ের হাতের খিচুড়ি খাবো!" কিন্তু সেই পশুর দল কি তা হতে দিলো? না, সেই কালো রাতে একটু চাঁদের আলো জ্বালিয়ে দেয়ার মতোও দয়াবান কেউ ছিলো না। ক্ষমতা, ক্ষমতা, ক্ষমতা! ক্ষমতার প্রভাব দেখানোর কাছেই নিজেদের অস্তিত্ব বিসজর্ন দিলো সেই কুলাঙ্গারেরা। তারপর কি হলো? মায়ের বুক খালি হলো, বন্ধু তার পিএলের সাথী হারালো, ছোটভাই বড় ভাইয়ের বটছায়া হারালো আর বুয়েটে অঙ্কিত হলো এক কলঙ্কিত অধ্যায়।
তবে মুদ্রার অপরপিঠও আছে, এতোদিন ধরে নিশ্চুপ শিক্ষার্থীরা ভাই হত্যার প্রতিবাদে মুখরিত হয়ে উঠে। হয়তো দেরি হয়, কিন্তু প্রায় সবাই নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং যোগ দেয় আন্দোলনে। তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। বুয়েটে আসে আমূল পরিবর্তন। ছাত্র-রাজনীতির অবসান সেই আমূল পরিবর্তনের সূচনাদ্বার মাত্র।
ছাত্ররাজনীতির অবসানের পর পরিবর্তনের ধারা শুরু হয় হলে হলেও। একসময়ের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে থাকা ক্ষমতার চিন্তাধারা থেকে সরে আসে ক্যাম্পাসের মানুষজন। উদাহরণ হিসেবে, শেরে বাংলা হলের উদাহরণই আনা যাক, যে হল ছিলো আবরারের দ্বিতীয় বাসস্থান, যে হলের মানুষজন তার জুনিয়র, ব্যাচমেটকে রক্ষা করতে পারেনি, সেই শেরে বাংলা হলের গল্পই নাহয় তুলে ধরা যাক। বন্ধু হারানোর শোক হোক আর জুনিয়রকে বাঁচাতে না পারার গ্লানি থেকেই হয়তো, নতুন পরিবেশ গড়ে তুলতে এগিয়ে আসে সকল শিক্ষার্থীরা। আগে যেমন মেসিং মাসে সবচেয়ে জুনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দাগ কাটতো, সে দায় নিজেদের কাঁধে নিয়ে নেয় মোস্ট সিনিয়র ব্যাচের ভাইরা। আগে গুটিকয়েক শিক্ষার্থীরা যেখানে হলের সার্বিক সিদ্ধান্ত নিতো, সেখানে একতাবদ্ধ হতে থাকা শেরে বাংলা হলের শিক্ষার্থীরা সকলে একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রথা চালু করে। শুধু তা-ই না, সেখানে সকল শিক্ষার্থীর মতামতের সমান গুরুত্ব দেয়ার রীতিও চালু হয়। হলগুলোর এ সুবাতাস শুধু হলেই সীমাবদ্ধ না থেকে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বুয়েটে। রক্তের দাগ হাতে নিয়ে এতে এই সুবাতাস ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে নেয় '১৫ ব্যাচের মানুষজন।
শুধু নিজেদের স্বাধীনতা উপভোগের মধ্যেই যে বুয়েটের শিক্ষার্থী সীমাবদ্ধ, তাও কিন্তু নয়। বর্তমানে আবরারের ভাইয়েরা মিলে চেষ্টা করছে, যাতে বুয়েটে আবরারের স্মৃতিকে দীর্ঘায়িত করা যায়। নিজেদের ভুলে ভাইকে হারানোর কষ্ট যেনো আর কোনো বুয়েটিয়ান কে নিতে না হয়, সেজন্য বুয়েটে নানা কর্মসূচী বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। এরমধ্যে, বুয়েটের কোনো একটি ভবনকে আবরার ফাহাদের নামে নামকরণ, আবরার ফাহাদের স্মৃতি সংরক্ষণে হলে তার ১০১১ নম্বর রুমের রুম নম্বর পরিবর্তন এবং বুয়েটে তার স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন অন্যতম। শিক্ষার্থীদের এরূপ প্রচেষ্টাগুলো কতটুকু সুফল পাবে জানা নেই, তবে এদের পূর্ণ বাস্তবায়ন আবরারের স্মৃতি এবং ছাত্ররাজনীতির ভয়াল থাবার কথা পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির অবসানের মাধ্যমে বুয়েটে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ফুলগুলো যেন পরিপূর্ণভাবে আবার বিকশিত হতে শুরু করেছে, যেনো নতুন বাতাস এসে বুয়েটের পালে হাওয়া যুগিয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের আগের নিশ্চুপতার ফল। তারা বুঝতে পারছে, বুয়েটে তাদের নিজেদের অধিকার, তাদের অস্তিত্বের অধিকার ক্ষুন্ন করার অধিকার অন্য কারো নেই। তাই তারা এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের অধিকার সংরক্ষণে, ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণে, একটি সুস্থ স্বাভাবিক ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে। বুয়েটে এই নতুন নির্মল বাতাস কতদিব বইবে, তা জানা নেই, তবে এই নতুন বাতাসের সূচনার জন্য পিছনে একজন মানুষই আছে, "আবরার ফাহাদ"। তাই আশা রাখি, বুয়েটের প্রতিটি হৃদয়ে বেঁচে থাকুক আবরার ফাহাদ, প্রতিটি সুন্দর পরিবর্তনে বেঁচে থাকুক আবরার ফাহাদ এবং বসন্তের বাতাস এসে রাঙিয়ে দিক বুয়েটের সকল পতিত আত্মাকে, যাতে আবরার দূর থেকে দেখে হাসতে পারে এবং সহস্র হৃদয়ে তার প্রতিধ্বনি দেখতে পারে।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!