তারিখ : ২০/০৫/২৩ স্থান : ECE Building, BUET
ঢাবি পরীক্ষা যেতে না যেতেই দরজায় কড়া নাড়তে থাকে বুয়েট প্রিলি পরীক্ষা। আমি ছিলাম ২য় শিফটের পরীক্ষার্থী। বিকাল ৩ টায় ছিল পরীক্ষা। আগেরদিন রাতে ১১ঃ০০ টার আগে ঘুমিয়ে ফজরের সময় ঘুম থেকে ওঠি। তারপর ৮ টার দিকে নাস্তা করে আবার ঘুমাই সকাল ১১ঃ৩০ টা পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি ঘুমিয়ে পরীক্ষার হলে যাওয়ার স্মৃতি বুয়েট প্রিলিতে। ১ম শিফটের পরীক্ষা ছিল সকাল ১০ টায়। তাই ভেবেছিলাম আমি বিকালে পরীক্ষা দিয়ে না আসা পর্যন্ত সকালের পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেমন হয়েছে বা কী এসেছে এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করব নাহ। ১১ঃ৩০ টার পর ঘুম থেকে ওঠে ফেসবুকে ঢুকতেই দেখি এক ভাইয়া পোস্ট করেছে "শিফট ১ এর পরীক্ষা কেমন হয়েছে তোমাদের?" সিদ্ধান্ত নিলাম যে ভুলেও এর কমেন্ট সেকশনে যাওয়া যাবে নাহ কারণ যদি বলে প্রশ্ন কঠিন এসেছে বা এটা পারি নাই তাহলে আমিও একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতে পারি। হোয়াটসঅ্যাপ এ উদ্ভাসের ফার্মগেট ব্রাঞ্চের তুখোড়দের একটা গ্রুপ ছিল। ঐটাতে ও ২২০+ মেসেজ ওঠে ছিল। তাই পরীক্ষার আগে এটাকেও ইগ্নোর করেছি যাতে অন্যদের কথায় কোনো ধরনের মানসিক চাপ অনুভূত না হয়।
১২ঃ৩০ এর দিকে বের হয়ে হোটেলে লাঞ্চ করে ১ঃ১৫ এর দিকে ফার্মগেট এর কাছে UAP এর সামনে থেকে সিএনজি নিয়ে পলাশীর মোড়ে বুয়েটের উদ্দেশ্যে যাই। কিন্তু ঐ দিন যে মানবিক বিভাগের সমন্বিত ভার্সিটি পরীক্ষা (GST) ছিল, তা আগে জানতাম নাহ। রাস্তায় প্রচুুর জ্যাম। একেবারেই যেন সিএনজি এগোচ্ছে নাহ। ঐদিন সত্যিই খুব বাজে অবস্থা দিয়ে যাচ্ছিলাম। ট্রাফিক জ্যামের কারণে ২ঃ১৫ বেজে গিয়েছিল রাস্তায়। যতই সময় যাচ্ছে অস্বস্তি বাড়ছে। এমনকি টানা ১৫-২০ মিনিট এক জায়গায় থাকতে হচ্ছে। ড্রাইভার আঙ্কেলকে বললাম বিকল্প কোনো পথে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে কীনা... ওনি বললেন সব রাস্তায় জ্যাম। এই অংশের জ্যামটা পার হতে পারলেই আর সামনে সমস্যা হবে নাহ। কিন্তু ঐ মুহুর্তে যতটা সম্ভব নিজেকে কুল রাখার চেষ্টা করছি যাতে কোনো অবস্থায় আতঙ্কিত না হয়। একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছে আজকে কী পরীক্ষা দিতে যেতে পারব কীনা... ঐ দিনের মতো এমন পরিস্থিতি আর কোনো পরীক্ষায় হয় নি।
২ঃ৩০ টার দিকে সিএনজি পুনরায় চলা শুরু করল। ড্রাইভার আঙ্কেল আমার অবস্থা বুঝতে পেরে অনেক দ্রুত সিএনজি চালাতে লাগলেন। একের পর এক ওভারটেক করে ছুটতে লাগলেন। একসময় আব্বু বলতে বাধ্য হলো যে একটু আস্তে যান। আমিও ওনার এই ভয়ংকর গতি দেখে অনেকটা বিস্মিত ছিলাম। মনে হচ্ছে এই বুঝি বাসের / রিকশায় লাগিয়ে দিবে...
অবশেষে ২ঃ৩৫+ এর দিকে পলাশীর মোড়ে গিয়ে পৌঁছাই। ওই ড্রাইভার আঙ্কেলের গতি দেখে মনে কিছুটা আত্মবিশ্বাস পাচ্ছিলাম যে এত এত গাড়ি টপকে ওনি যেভাবে সামনে যাচ্ছেন আমাকে ও স্বপ্নজয়ে এত মেধাবীদেরকে টপকে নিজেকে সামনে এগিয়ে রাখতে হবে। এমন সময় এক পরীক্ষার্থী মেয়ে এসে বলল, "ভাইয়া ইসিই বিল্ডিং কোনদিকে? " আমি নিজে ও তখন কোনদিকে যাব বুঝতেছিলাম নাহ তাই তাকে স্কাউটের সাহায্য নিতে বললাম। তারপর বহুল কাঙ্ক্ষিত বুয়েটের ইসিই তে পৌঁছে ১ মিনিট গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে হাত মুখ ধুয়ে আম্মুকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি বলে ভেতরে গেলাম।
ইসিই তে যে কক্ষে পরীক্ষা দিয়েছি সেখানে গিয়ে দেখি স্যার এসে পড়েছেন। বিভিন্ন নির্দেশনা শুনছে সবাই৷ আমি আমার আসনে গিয়ে বসি৷ পাশে বসেছিল হলি ক্রসের এক মেয়ে। পরীক্ষা শুরুর আগে ভাবছি আমি তো আলহামদুলিল্লাহ পৌঁছে গেছি। যারা এখনো রাস্তায় আছে তাদেরকে ও যেন আল্লাহ দ্রত পৌঁছে দেন। অল্প সময় পর পরীক্ষা শুরু হয়। প্রশ্ন পেয়ে যা পারি বৃত্ত ভরাট করতেছি। কিন্তু বেশ কিছু প্রশ্নে সঠিক উত্তর অপশনে ছিল নাহ। তাই ঐ গুলো বারবার চেক করতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়। বাসা থেকে নিয়ত করে গিয়েছিলাম যে প্রিলিতে টপ ৬০০০ জনে থাকতে হলে সব পারার দরকার নেই। ঠান্ডা মাথায় যতটা পারব দাগিয়ে বের হয়ে যাব। ঘণ্টা বাজার আগে পর্যন্ত ৭০+- দাগিয়াছিলাম সম্ভবত (প্রকৃত সংখ্যা হিসাব করি নাই)। বের হয়ে শুনি সবাই বলে ৮০-৮৫+ দাগিয়েছে। বরাবরই মোটামুটি পারলেও কিছু এমন থাকে যা পরীক্ষার হলে ভুলে যাই। তাই সব মিলিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় আছি আসবে তো??? এর আগে ঢাবি মনমতো হয় নি। এখন বুয়েট প্রিলিতে না আসলে তো আরো সমস্যা। পরীক্ষার পর বাসায় এসে ভাবলাম সামনের সব পরীক্ষায় আরো ১-১.৫ ঘন্টা আগে বের হব। আজকে যে অবস্থা ছিল...
তবে প্রিলির রেজাল্টের পর ভয় বেশি বেড়ে গিয়েছিল। রিটেনে গিয়ে যদি বাদ পড়ে যায়...
(স্বপ্নজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ: একটি পরিচয় পাওয়ার আশায় ২ ঘণ্টার একটি পরীক্ষা)
তারিখ : ১০/০৬/২৩ কেন্দ্র : কক্ষ- ৩১০ (৩য় তলা), ডাঃ জামিলুর রেজা চৌধুরী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিং, বুয়েট।
প্রিলি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর একটু বেশি ভয় কাজ করছিল যে তীরে এসে যেন তরী না ডুবে যায়। শেষ ধাপটা যেন সুস্থভাবে পার হয়ে আসতে পারি। প্রিলিতে চান্স পাওয়ার বিষয়টি নিজে থেকে বাইরের তেমন কাউকে জানাই নি লিখিত পরীক্ষার চূড়ান্ত ধাপটা তখনো বাকি থাকায়। কয়েকজন ফ্রেন্ড প্রিলির রেজাল্ট না জানানোতে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল।
বুয়েটে পর্যাপ্ত সময় হাতে রেখে পৌঁছেছিলাম। বুয়েট সেন্ট্রাল মসজিদের সামনে থেকে হেঁটে আহসানউল্লাহ হলের দিকে যাওয়ার সময় স্কুলের ক্লোজ ফ্রেন্ড প্রান্ত (BUTEX -22) এর সাথে দেখা হয়ে যায়। সে ও আমার মতো পরীক্ষা দিতে সেজেগুজে হাজির। উদ্ভাসের ফার্মগেট ব্রাঞ্চের কোঅর্ডিনেটর সুজন ভাই এর সাথে দেখা হলে বুক মিলিয়ে শুভকামনা জানান। কিছুক্ষণ পর আমার এলাকার তুহিন ভাইয়ার (BUET CSE-21) সাথে কথাবার্তা বলে পরীক্ষা দিতে যাই।
৩১০ নম্বর রুমের ডান পাশের সব সিট ছিল জোড়ায় জোড়ায়। পরীক্ষার হলে আগে গিয়ে দেখি পাশের সিটে ফাইল রাখা কিন্তু পরীক্ষার্থী নেই। কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে এসে চুপচাপ বসলো৷ আমি জানালার দিকে আর সে আমার বামে। আরো প্রায় ৩০ মিনিট এক জায়গায় চুপচাপ বসে জানালা দিয়ে অন্য পরীক্ষার্থীদের হলে প্রবেশ দেখছিলাম। মন থেকেই আল্লাহর কাছে চাচ্ছিলাম যেন একটা উত্তম ফায়সালা করে দেন। যা পারি নাহ তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই কিন্তু যা পারার মতো আসবে ঐগুলোতে যেন ভুল না করি। ২ ঘণ্টায় নিজের এত দিনের পরিশ্রমের সবটা ঠিকমতো দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। স্যার এসে নির্দেশনা কড়াকড়িভাবে বুঝিয়ে নির্ধারিত সময়ে প্রশ্ন দিলেন।
ম্যাথ পরে আন্সার করব ভেবেই রেখেছিলাম। ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি এর মধ্যে কোনটা দিয়ে শুরু করব ভেবে লেখা শুরু করলাম। তবে প্রথম ৫ মিনিট মনে হচ্ছিল যা দেখছি তার অনেক কিছুই পারি নাহ। কঠিন প্রশ্নগুলো স্কিপ করে তুলনামূলক পারা জিনিসগুলো আন্সার করতে থাকি। যা পারছি না কোনোরকম প্যানিকড না হয়ে স্কিপ করলাম। এক পর্যায়ে মনে হলো যা শোচনীয় অবস্থা হয়তো পারব নাহ। কারণ ব্যক্তিগত দোষে ম্যাথের কিছু অধ্যায় রিভিশন দিয়ে না যাওয়ায় ঐগুলো থেকে সহজ প্রশ্ন আসলেও একদম আন্সার করতে পারি নাই। ম্যাথগুলো দেখে মনে হচ্ছে বই এর এই জায়গায় আছে কিন্তু কোনোভাবে মিলাতে পারছি নাহ। ঐরকম ২০-৩০ নম্বর শুধু ম্যাথেই হারাতে হয়েছে। কেমিস্ট্রি এর একটা পারা ম্যাথ করতে পারি নাই একক চেঞ্জ করে দেওয়া ছিল বলে। এককের পরিবর্তনগুলো বাসায় পারলেও রিভিশন দেয় নি বলে torr/ bar থেকে atm এ নিতে পারি নাই। ফিজিক্সে ও পারা কিছু ম্যাথ মিলাতে না পারলেও ২ দিন আগে রিভিশন দেওয়া একটা ম্যাথ হুবহু কমন পড়েছিল (বাসায় রিভিশন দেওয়ার সময় কেন যেন মনে হচ্ছিল এটা আসতে পারে)। সব মিলিয়ে PCM এ ঐ মুহুর্তে পারি নাই কিন্তু এমনিতে পারতাম এমন নাম্বার যথেষ্ট হারিয়েছি। কেমিস্ট্রির একটা প্রশ্নের আন্সার করতে বায়োলজির পরিপাক অধ্যায়ের কিছু বিক্রিয়া মনে থাকায় লাভ হয়েছিল। ৩০ মিনিট আগে দেখলাম ৪০ টার মধ্যে ২৬-২৭ টা আন্সার করছি। বাকিগুলো পারি নাহ। যোগজীকরণের একটা ম্যাথ নিয়ে অনেক সময় দিয়ে শেষে হঠাৎ মিলে যায়। বুয়েট প্রিলিতে পারি অনেক কিন্তু সময় কম। আর রিটেনে পারি কম তবে সময় আছে। পরে আরো কিছু পার্শিয়াল আন্সার করেছিলাম। মোটামুটি ২৮-২৯ এর কাছাকাছি হবে যদিও কিছু ম্যাথ সবটা হবে নাহ জেনেও এপ্রোচ করে চিত্র এঁকেছিলাম ও যতটুকু সম্ভব করার চেষ্টা করি। পরীক্ষা শেষে ঘণ্টা বাজার পর স্যারের "Stop Writing" শোনার সাথে সাথে বুকটা ধুকধুক করতে লাগল যে বুয়েটকে আমার কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম নাতো।
বের হয়ে সিড়ি থেকে নামার সময় অপরিচিত পরীক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে বলতে ক্যাম্পাস থেকে বের হলাম। এক ছেলে (ঢাবিতে টপ করা) বলল, "আমার বুয়েট সিএসই মিস। ইশশ ইন্টিগ্রেশন এরটা পারি নাই। " এক মেয়ে বলল, "ম্যাথ কী কেতাব স্যারের বই থেকে এসেছে সব? আমি তো এস ইউ আহমেদ পড়তাম "। কয়েকজনের কথা শুনে বুঝলাম ম্যাথেই সবাই বেশি প্যারা খায়ছে। পাশের ছেলেটা যখন বলল ঐ ম্যাথগুলো ডিরেক্ট বই থেকে আসায় কম সময়ে পেরেছে (যেগুলো রিভিশন না দেওয়ায় আমি পারি নি), তখন আফসোস হচ্ছিল যে এভাবে ৩০-৪০ নম্বর মিস করলাম। সিভিল বিল্ডিং থেকে বের হয়ে আসার সময় পেছনে ফিরে তাকিয়ে ভাবছিলাম আর ছাত্র হিসেবে এই বুয়েটে আসা হবে তো...নাকি এখানেই শেষ... আব্বুর কাছে আসার পর বলল, " তোমার ম্যাথ কেমন হয়েছে? সবাই বলছে ম্যাথ নাকি কঠিন আসছে?" তারপর তুহিন ভাইয়ার সাথে দেখা করে বিদায় নেয়ার সময় কলেজের ব্যাচমেট তাহসিনকে (CUET ME-22) দেখলাম। পরীক্ষার পরপর আম্মু, তুহিন ভাইয়া, উদ্ভাসের সুজন ভাইয়া ফোন দিয়ে খোঁজ নেয় কেমন হয়েছে।
বুয়েট রিটেনের দিনই পরীক্ষার পর ঢাকা থেকে এডমিশন কোচিং এর যাবতীয় মালামাল নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাত্রা করেছিলাম। তাই পরীক্ষার আগেই জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছিলাম সব। পরীক্ষা দিয়ে এসেই সব নিয়ে বেরিয়ে যায়। এক বহুল কাঙ্ক্ষিত পরীক্ষার ইতি টেনে রাজধানী ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার সময় ভাবছিলাম, "হয়তো ভাগ্যে ঢাকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থাকলে আবার আসতে হবে এই ব্যস্ত নগরীতে উচ্চ শিক্ষা অর্জনে...আর রইল ১৭/০৬/২৩ এর CKRUET পরীক্ষা....." এমনটা ভাবতে ভাবতেই কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে উপকূল এক্সপ্রেসে করে ঢাকা ত্যাগের মাধ্যমে ঢাকার এডমিশন জার্নির সমাপ্তি ঘটে।
আর কখনো এডমিশনের ঐদিনগুলো ফিরে আসবে নাহ। কোন ভার্সিটিতে চান্স হবে এই অনিশ্চয়তায় রাত জেগে পড়ার টেবিলে অনলাইন ক্লাসের সেই বিরক্তিকর মুহুর্তগুলো ফিরে পাব নাহ। এইচএসসি সিলেবাসের খুটিনাটি গ্যাপ পূরণে এক অজানা আতঙ্ক তাড়া দিবে নাহ। দিনশেষে ভর্তিযুদ্ধে জয়ীদের তালিকায় থাকব কীনা তা নিয়ে শঙ্কা থাকবে নাহ। এডমিশন টাইম কবে শেষ হবে তা নিয়ে আর উদগ্রীব হব নাহ। আমিও আর কোনোদিন বুয়েটে চান্স পেতে নতুন করে স্বপ্ন দেখব নাহ...
নতুন জীবন, নতুন স্বপ্ন, নতুন যাত্রাপথে পুরোনো এই আমি...
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!