আগস্ট ১২, ২০০০...
রাশিয়ান নেভির নর্দান ফ্লিটের অন্যতম বড় মেরিটাইম এক্সারসাইজ Summer-X চলছে যেখানে ত্রিশটি যুদ্ধজাহাজ এবং তিনটি সাবমেরিন অংশ নিয়েছে। এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর রাশিয়ার বড় পরিসরে আয়োজিত প্রথম নেভাল এক্সারসাইজ। আর্কটিক মহাসাগরে রাশিয়ান এবং নরওয়েজিয়ান জলসীমার সংযোগস্থলের কাছাকাছি বারেন্টস সাগরে এক্সারসাইজটি চলছে। এতে অংশগ্রহণ করা তিনটি সাবমেরিনের মধ্যে একটি হচ্ছে Oscar II class সাবমেরিন Kursk (K-141) । এটি হচ্ছে এযাবৎকালের অন্যতম বড় সাবমেরিন। (রাশিয়ান সাবমেরিনগুলো এমনিও দানবাকৃতির)
আগে K-141 সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। ১৯৯০ এ লঞ্চ হওয়া সাবমেরিনটি ছিল একটি নিউক্লিয়ার পাওয়ারড নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ক্যারিয়ার সাবমেরিন এবং বিশেষ সাবমেরিনগুলোর একটি যেটাতে সবসময় ওয়েপন ব্যাটেললোড অবস্থায় থাকতো, অর্থাৎ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতো। এর RPK-6/RPK-7 টর্পেডো গুলো নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড বহন করতে পারতো। তাছাড়া নিউক্লিয়ার পাওয়ারড নিউক্লিয়ার স্ট্রাইক ক্যাপাবল Poseidon UUV (Unmanned Underwater Vehicle) ক্যারি করতো। এছাড়াও ছিল P-700 Granit অ্যান্টিশীপ ক্রুজ মিসাইল যার রেঞ্জ ৬০০ কিলোমিটারের বেশি। সার্ফেসড অবস্থায় এর ডিসপ্লেসমেন্ট ১৪,৫০০ টন, যা একটি ক্রুজারের সমতুল্য। এর দৈর্ঘ্য ১৫৫ মিটার যা প্রায় দুটি জাম্বো জেটের সমান। সাবমেরিনটি টেস্ট ডেপ্থ অনুযায়ী ৬০০ মিটার পর্যন্ত পানির নিচে যেতে পারত। সাবমেরিনটি নয়টি কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত ছিল, এর বাইরের অংশটি ৮ মিমি স্টিলের পাতের উপর ৩ ইঞ্চি রাবারের প্রলেপ দিয়ে তৈরি ছিল। মাঝে ২/৩ মিটারের গ্যাপ রেখে ভিতরের অংশ ২ ইঞ্চি স্টিলের পাত দিয়ে তৈরি ছিল। বেসিক্যালি একে Unsinkable অর্থাৎ অডুবনীয় বলা হতো এবং এটি টর্পেডোর ডিরেক্ট হিটও সহ্য করতে পারত বলে দাবি ছিল রাশিয়ার। এককথায় সবদিক থেকেই এটি সমুদ্র তলদেশের দানব ছিল।
এখন আবার ফিরে আসা যাক সেই এক্সারসাইজের দিনে। ১১৮ জন ক্রু নিয়ে সাবমেরিনটি এক্সারসাইজে অংশগ্রহণ করে। এক্সারসাইজের অংশ হিসেবে K-141 এর থেকে দুটি ডামি টর্পেডো Kirov class battlecruiser এর উদ্দেশ্যে ফায়ার করার কথা ছিল। সেই পরিকল্পনা অনুসারে কমান্ড শিপের অনুমতি নিয়ে K-141 ডুব দেয়। ডামি টর্পেডো 'Fat Girl' লোড করা হয় ফায়ারের উদ্দেশ্যে। টর্পেডোগুলোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড H²O² (২ নিচে হবে) জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তো নির্দেশনা অনুযায়ী ফায়ার করার জন্য প্রস্তুত হলো টর্পেডো, কিন্তু ফায়ার করার আগেই কোনো এক কারণে H²O² লিক করে টর্পেডো হ্যাচের মধ্যেই বিস্ফোরণ হলো। এই বিস্ফোরণটি আরও ৫-৭টি টর্পেডোকে ট্রিগার করে ফেলল, ফলে একসাথে সবগুলো টর্পেডোই সাবমেরিনের ভিতরেই বিস্ফোরিত হলো। যার ফলে সামনের দিকের কম্পার্টমেন্টগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল। বিস্ফোরণের ইমপ্যাক্ট এত ছিল যে ইউরোপ জুড়ে রিখটার স্কেলে ৪.২ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল!প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরণের পর অন্যান্য কম্পার্টমেন্টে থাকা ২৯জন ক্রু বেঁচে ছিল। নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর নিরাপদে বন্ধ করে তারা ইমার্জেন্সি হ্যাচে আশ্রয় নেয়। এদিকে আরেকটি সাবমেরিন Karelin আঁচ করতে পারে কিছু একটা গরবর হয়েছে। যদিও কমান্ড শিপকে জানানো হলেও এটাকে এক্সারসাইজের অংশ বলেই ধরে নেয় কমান্ড সেন্টার। কিন্তু যখন টর্পেডো হিটিং এর নির্ধারিত সময় পার হয়ে অতিরিক্ত সময়ও চলে যায় তখন তারা বুঝতে পারে K-141 আদতে ঠিক নেই। তারা তাৎক্ষণিকভাবে খোঁজাখুঁজি শুরু করে এবং যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, কিন্তু কোনো রেসপন্স নেই। এদিকে ছয় ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে বিস্ফোরণের। বেঁচে থাকা ২৯ জন ক্রুর অক্সিজেন সরবরাহ শেষের দিকে। উদ্ধার তৎপরতা চললেও তাদের থেকে অনেক দূরে। অন্যদিকে নেভি কোয়ার্টারে ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে খবর, K-141 দূর্ঘটনায় পড়েছে। নাবিকদের স্ত্রী সন্তানেরা উদগ্রীব, এদিকে রাশিয়া বিষয়টিকে চাপা রাখার চেষ্টা করছে। তাদের বলা হচ্ছে সাবমেরিনটি আনসিংকেবল, এটা শুধু একটা টেকনিক্যাল এরোর এবং কমিউনিকেশন প্রব্লেম। খোঁজার অনেক চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। সাবমেরিনের ইমারজেন্সি রেসকিউ বয়াটাও ইচ্ছাকৃতভাবেই বন্ধ রাখা ছিল এক্সারসাইজের অংশ হিসেবে,ফলে কোনো চিহ্ন ও পাওয়া যাচ্ছে না।
আশেপাশের দেশগুলো ততক্ষণে বিষয়টি জেনে গেছে এবং সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া সেটি গ্রহণ না করে নিজেরাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে দুইদিন পর অন্যান্য দেশের সাথে একত্রিত হয়ে সাবমেরিনটি লোকেট করা সম্ভব হয়। কিন্তু এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে ততক্ষনে সেখানে আর কেউ জীবিত নেই। সাবমেরিনটির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার তৎপরতা চলতে থাকে। ঘটনার প্রায় এক বছর পর সাবমেরিনটির ধ্বংসাবশেষ সমুদ্র তলদেশ থেকে তুলে আনা হয়। সেই সাথে ১১৫ জন নাবিকের দেহাবশেষ পাওয়া যায়, তাদের রাশিয়ায় নিয়ে দাফন করা হয়। বাকি তিনজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এখনও!
এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ সাবমেরিন দুর্ঘটনা। এই ঘটনাটি নিয়ে মুভি ও বানানো হয়েছে, যদিও আমার দেখা হয়নি সেটা। পৃথিবীর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং পেশার একটি হচ্ছে একজন সাবমেরিনার হওয়া! প্রতিমুহূর্তে যেখানে মৃত্যুর হাতছানি, আর অজানা এক যাত্রা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ নৌবাহিনীতেও দুটি অ্যাটাক সাবমেরিন আছে। সাবমেরিন দুটোর নাম যথাক্রমে বানৌজা জয়যাত্রা এবং বানৌজা নবযাত্রা। এগুলো চীনের তৈরি মিং ক্লাস সাবমেরিন, যা বর্তমানে নাবিকদের প্রশিক্ষণ এবং শান্তিকালীন টহলে নিয়োজিত আছে।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!