কিছু যেন একটা ফেলিয়া আসিয়াছি। প্রতিবার বাড়ি থেকে ফিরিবার পথে এই একটা অনুভূতি আমার কিছুতেই পিছু ছাড়িতে চায় না। বারবার ব্যাগগুলো দেখিয়া লই এবং প্রতিবারই সেই ভ্রম ভাঙ্গিয়া যায়। হিসাব করিয়া দেখি কিছু ফেলিয়া তো আসিই নাই বরং আরো অতিরিক্ত কিছু সংযোজিত হইয়া ব্যাগ-পত্র বেশ ভারী হইয়া উঠিয়াছে। সবকিছুই ঠিকঠাক আছে ,ইহা ভাবিয়া আমি নিজেকে স্থির করি। কিন্তু পুনরায় মনে হয় কি যেন একটা মনের অজান্তে বাদ পড়িয়া গিয়াছে। তাহলে ভুল করিয়া প্রিয় শ্রীকান্তকে রাখিয়া আসি নাই তো ?
ব্যাগের চেইনটা টানিয়া আরেকবার দেখিয়া লইলাম। সেটা যথাস্থানেই রাখিয়াছি। তাহলে কিসের এই মহাশূন্যতা , এত দ্বিধা -দ্বন্দ্ব ?
আরেকটু ভালোভাবে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম বাবা-মার যে স্নেহ ,মায়া ,মমতা আমার সমগ্র হৃদয়কে আবৃত করিয়া ছিল। তাহার অনুপস্থিতিই আমাকে এই দ্বিধার লুপে আবদ্ধ করিয়াছে। বিশুদ্ধ ভালোবাসার উপস্থিতি কালে আমরা যতটা উদাসীন। ইহার অনুপস্থিতি আমাদের ততই সজাগ করিয়া তোলে। প্রতিটি বাবা -মা ই নাকি গ্যালাক্সির শ্রেষ্ঠ বাবা মা। কিন্তু আমার বাবা-মা শ্রেষ্ঠদের শ্রেষ্ঠ বাবা-মা বলিয়া মনে হয়। অন্যদেরও অনুরূপ মনে হইতে পারে।
আমি অমুক তারিখে আসিব বলিয়া অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকা, রাস্তায় চলাকালে অতিশয় সাবধানতা অবলম্বন করিতে বারংবার সতর্ক করিয়া দেওয়া, আমার পছন্দের খাবার গুলো সযত্নে সংরক্ষণ করিয়া রাখা, বাড়িতে বেশি টাকা খরচ করিতে বারবার বারন করিয়া দেওয়া.. ভালোবাসার এই সুস্পষ্ট নিদর্শন গুলো লিখিতে গেলে শব্দের পর শব্দ লেখা যাইবে তবুও ইহার সমাপ্তি হইবে না। এইগুলো শুধু নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় নয় বরং স্বার্থত্যাগীও বটে। ছাত্রজীবনে অধিকাংশকে এই সকল বিশুদ্ধ মমতা হইতে দূরে থাকিতে হয় বলেই ভালোবাসার অন্য শাখা গুলি এতটা প্রকট হইয়া ওঠে। হৃদয়ে ভালোবাসার অতি সামান্য সিএফটিও অবশিষ্ট থাকেনা বাবা-মার জন্য। যে মমতার চাদরে মা আমাদের আবৃত করিয়া রাখে, পর্যাপ্ত বয়স পরেও যে বাবা কমান্ডার এর মত সাহস যোগায়। ইহার কি কোন বিনিময় হয়? হইতে পারে? মাঝে মাঝে বড় সংশয় হয় , নিজের কোন অবহেলা দায়িত্বহীনতা নাই তো আবার? গ্যালাক্সির শ্রেষ্ঠ ভালবাসার ঋণ কখনো শোধ করা যাইবে না সেটা জানি। তাহার প্রয়াস টুকু আছে তো? পৃথিবীতে সত্য,সৎ ও জগৎকল্যাণকর কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে এগোতে চাই। ইহাতে যদি সুখ ও সমৃদ্ধি হইতে বঞ্চিত ও হতে হয় আফসোসের বিন্দু বিসর্গ ও অবশিষ্ট থাকিবেনা। নিজের দুঃখ দৈন্যতা ও কন্টকময় জীবনের জন্য বিধাতা কে দোষারোপ করা যতটা সহজ, নিজের অবহেলা ও কুকর্মের অনুতাপ থেকে মুক্তি পাওয়া অতোটা সহজ নয়।
প্রতিবার ঢাকা থেকে বাড়িতে যাওয়ার সময় মস্তিষ্ক থেকে নগরকেন্দ্রিক সমস্ত সংযুক্তিতা অস্থায়ীভাবে মুছিয়া দিই। অন্যভাবে বলিলে শহুরে সফটওয়্যার আনইন্সটল করে গ্রামীণ সফটওয়্যার ইনস্টল করিয়া লই। এবং দশ দিনের ছুটিতে আসিলেও মানসিকভাবে এই সেট আপ করিয়া লই যে অনন্তকালের ছুটিতে আসিয়াছি এবং ফিরিবার দিন শুধু মনে করি যে আজিকে ফিরিতে হইবে। তাছাড়া ছুটি ফুরিয়া গেল ইহা ভাবিয়া সামান্য দিন কটিও উপভোগ থেকে বঞ্চিত হইতে হয়। গ্রাম যে আমাকে সাংঘাতিকভাবে আকর্ষিত করে এগুলো তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণ। ফিরিবার কালে মানসিক অবস্থার বিবরণ অগ্রাহ্য করিলেও বাড়ি হইতে বের হওয়ার সময়টাকে উল্লেখ না করিলেই না। বের হওয়ার সময় আমি সচরাচর পিছন ফিরিয়া তাকাই না। কারণ তাহাদের মলিন চেহারা আমাকে কঠিন ভাবে আঘাত করে তবুও আড়চোখে মায়ের চোখে তাকিয়ে দেখি...........
আবেগ প্রকাশের ভঙ্গিমা অভিযাত্রী সন্তান টের পাইয়া যায় কিনা, যাহার স্মৃতি পরবর্তীতে সন্তানের হৃদয়কে বিষন্ন করিয়া তুলিতে পারে, ইহা ভাবিয়া অধিক সতর্কতা সহিত মনের সকল আবেগকে চাপিয়া রাখিয়া অপলক দৃষ্টিতে ঝাপসা চোখে চাহিয়া রয়। আখি জলের সতস্ফূর্ত স্খলন যতই প্রমাণ করিতে চায় যে তাহা সামান্য আবেগেরই বহিঃপ্রকাশমাত্র কিন্তু ইহার অন্তরালে যে কত অসামান্য মমতা লুকাইয়া রাখা হয় যাহারা কোনদিন প্রত্যক্ষ করেনি তাহাদের বোঝানো সম্ভবপর নহে।
কি করিলে ভুলিয়া থাকা যায় সেই চাহনি? কোন ক্ষুরধার অস্ত্র দিয়ে সমস্ত অনুভূতি ছিন্ন করিয়া সংসারে একবচন হইয়া থাকা যায়?
এগুলো নিছক মনঃকল্প ব্যতিরেকে অন্য কিছুই না। যদি উহা সম্ভবই হইতো ধরণীকে হাজার হৃদয়ের আর্তবেদনার সাক্ষী হইতে হতো না। অতএব যাহার যেখানে স্থান থাকিয়া যাক বরং আমি আমার পথ খুঁজিয়া বাহির করি।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!