‘আজকে একটু তাড়াতাড়ি এসো বাইরে বেড়াতে যাবো। পারলে তিন দিনের ছুটির চেষ্টা করো।‘
রহমান সাহেব স্ত্রীর কথা শুনে বোধ হয় একটু বেশিই বিরক্ত হলেন। এই তো এক সপ্তাহ আগেই চিড়িয়াখানা নিয়ে গেছিলেন। এক সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই আবার বায়না! স্ত্রীর দিকে একবার কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে দ্রুত হেলমেটটা নিয়ে চলে গেলেন। ব্যাংকের চাকরি তো আর নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমানো নয়, কাগজ কলমে যথেস্ট খাটতে হয়। এরা এসব বোঝে না। শিউলি ছুটে গেল বেলকুনিতে। রহমান সাহেবকে চলে যেতে দেখা যাবে স্পষ্টভাবে। এই ২০ বছরে শিউলি অনেক সূত্র প্রতিষ্ঠা করেছে সংসারে। যেমন: অফিস থেকে ফিরে বেশি সময় ধরে স্নান করলে বুঝতে হবে আজকে মন খারাপ। তেমনি একটি সূত্র অফিসে যাওয়ার সময় বেলকুনিতে না তাকালে বুঝতে হবে তিনি আজকে যে বিরক্তিটা প্রকাশ করেছেন তা সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে কমে নি এবং তার অনুরোধও রক্ষা হবে না। এটাই সত্যি হল। রহমান সাহেব ক্ষীপ্তগতিতে চলে গেলেন। রাগ করেছেন। শিউলি ঘরে ফিরে গেল। এলোমেলো বিছানা ঠিক করলো। ঘর কাট দিল। রান্না করাই ছিল। রহমান সাহেব দুপুরের খাবার বাড়ি থেকেই নিয়ে যান। গোসল করে পরিপাটি হয়ে হয় বই পড়বেন, না হয় বেলকুনিতে বসে মানুষের চলাফেরা দেখবেন। শিউলি অবশ্য গল্প লিখতেও ভালবাসে। দোতলা বাড়ির দুই তালাতেই শিউলিরা থাকে। বাড়িওয়ালা ছাড়া আরো তিনটা পরিবার থাকে। বাড়ির সামনে বাগান আর সংক্ষিপ্ত বাগানপ্রস্থ অতিক্রম করলেই মেইন রোড। বাগান চিড়ে একটি রাস্তা বাড়ির সিঁড়ির শেষপ্রান্তের সাথে মেইন রোডকে যুক্ত করেছে। দুপুরে আযানের পর নামায পরে, খাওয়া দাওয়া। তারপর আবার একই কাজ। হয় বই পড়া না হয় মানুষ দেখা। এটাই তার জীবনের বর্তমান রুটিন। আজ সে পড়ছে ‘মনিষীদের জীবনী’।
শেষের দুই পৃষ্ঠায় উক্তি দেওয়া। তিনি পড়লেন একটি উক্তি। ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্রই তাকে শৃংখলিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।‘ বাহ! চমৎকার উক্তি। কে করেছেন এই উক্তি। জ্যাঁ জ্যাক রুশো। চেনা নাম না। তবে উক্তিটা বাস্তবসম্মত। বাহ! একটু ভাবা যেতে পারে উক্তিটা নিয়ে। বই বন্ধ করে পাশে রাখলো। বিছানায় একটু এলিয়ে দিলেন গা। আধশোয়া অবস্থা। চোখ বন্ধ করে ব্যাখ্যা শুরু করলেন মনে মনে। মানুষ শেকল পরা। লোহার শেকল নয়। দায়িত্বের শেকল। মায়ার শেকল। যা দেখা যায় না তবে নিশ্চিতভাবে তা লোহার শেকলের চেয়েও শক্ত। যা ধারাল কিছু দিয়ে কাতা যায় না। আগুনে তাপ দিয়েও ছিন্ন করা যায় না। অন্য কোনোভাবে কি ছিন্ন করা যায়? হয়তো না। একটা যুক্তি দেওয়া যেতে পারে। বাড়িওয়ালা জঘন্যরকম রাগী। সেই মানুষের মেয়েটা এক ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করল। এতে রাগে মাথার ঘিলু লাভার মত বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু তা হলো না। তিন মাস পর এই বদমেজাজী মানুষটাই কান্নাকাটি করে মেনে নিলেন মেয়ে জামাই কে। আগামী শুক্রবার সেই বিয়েরই অসমাপ্ত অনুষ্ঠান। বাড়িওয়ালা কেন কান্না করেছিলেন? অবশ্যই শেকলের জন্যে। এটাই মায়ার শেকল। শিউলিকে বেশি সময় ভাবতে হলো না তার শেকল আছে কিনা। বিয়ের ২০ বছর পর স্বামীর মায়ার শেকল দূর্বল হওয়াটা স্বাভাবিক। সন্তানহীন দম্পতি। সন্তান থাকলে সেই ব্যস্ততায় পুরো জীবনই পার হয়ে যেত। এই একটিমাত্র ব্যস্ততায় বোধ হয় মানুষ খুব সাদরে গ্রহন করে। দায়িত্বের শেকল। সন্তানের দায়িত্বের শেকল মানুষ ধুমধাম অনুষ্ঠান করে পড়ে।
শিউলিও খুব আনন্দের সাথেই সেই শেকল পড়তো । কিন্তু কার সাথে শেকল পড়বে । শেকলের এক প্রান্ত শিউলির পায়ে আরেক প্রান্ত ফাঁকা। শৃংখলিত হয়েও শৃংখলহীন। শিউলির তন্দ্রা কেটে গেল। মন যথেষ্ট খারাপ। ‘কেন যে এইসব ভাবতে গেলাম সুধু সুধু’। বেলকুনিতে চলে গেলেন। রাস্তায় এক দম্পতি তাদের দুই সন্তানদের নিয়ে বের হয়েছেন। বেশ লাগছে বাচচা দুটোকে। বাচচাদের আদর করতে মন চাচেছ শিউলির। এমন সময় বাড়িওয়ালার ১২ বছরের রিংকু আর পাশের ফ্ল্যাটের হক সাহেবের ছেলে বজলু নিচে নেমেছ বাগানে খেলতে যাচেছ। ক্রিকেট খেলবে বোধ হয়। ব্যাট বল নিয়ে নামছে। আরও কয়েকজনকে নিয়ে ওরা এখানেই খেলে প্রতিদিন। দিনের মধ্যে এই ২ ঘন্টাই ভাল লাগে। নিজেকে কিছুটা ব্যস্ত মনে হয়। ঘড়ি দ্রুত চলে মনে হয়। আসলেই কি দ্রুত চলে? শিউলি বেলকুনির গ্রিলে মাথা লাগিয়ে এক মনে বাচচাদের খেলা দেখছে। বজলু কেমন করে যেন তাকালো। যেন অতৃপ্তির চাহনি। মনে হয় বাচ্চাটা তার কাছে আসতে চায়। বাচচাদের মন সবচেয়ে সরল। তারা পৃথিবীর জটিলতা সম্পর্কে জানে না। হক ভাবি হয়তো নিষেধ করেছেন। নিষেধ করার মতো কিছু ঘটেনি। গত রবিবার লুনাকে (বজলুর বোন) চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন। মাথার দুপাশে বেণী করে মেয়েটাকে দেখতে এত সুন্দর লাগতেছিল যেন পরী নেমে এসেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচিছলেন শিউলি। এমন সময় দরজা খুলে রেগে এসে মেয়েকে চর মারলেন।
-কি রে! তোকে কতবার বলেছি এইদিকে না আসতে। কথা কানে ঢোকে না। পাড়াবেরুনী হয়েছ? চল আজকে ঠ্যাং ভেঙে দেব তোমার।
-ভাবি। ওকে মারছেন কেন? ও তো বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটা কিভাবে কান্না করছে দেখেন ভাবি! কে শুনে কার কথা। টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচছে। বলতে শোনা গেল ‘অমঙ্গল টেনে আনতে চাস?’ সত্যি অনেক ছোট। ওর মা যেসব বলল ওকিছুই বুঝবে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। বোঝার কথাও নয়। নিঃসন্তান দম্পতি হিসেবে শিউলিদের ‘অমঙ্গলের’ প্রতীক হিসেবে দেখছেন হক ভাবি। যার কারণে চুল বাঁধা ফিতে পর্যন্ত দিয়ে গেছেন ঐ দিনই। কি বিশ্রী! অবশ্য পরদিন এসে বলেছিলেন –‘কিছু মনে করেন না রহমান ভাবি। ওর বাবার সাথে সেদিন বেশ ঝগড়া হয়েছিল। তাই রাগের মাথায় ওসব বলেছিলাম। কিছু মনে কইরেন না ভাবি।‘
-না। কিছু মনে করিনি।
শিউলি ভালো করেই জানে হক সাহেব আর যাই করুক বউ এর সাথে ঝগড়া করেন না। খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ। যদিও ঝগড়া করে থাকে সেটা অবশ্যই শোনা যাবে। এটা মুখের কথা। মনের কথা ভিন্ন। শিউলিকে অঘটনার প্রতীক মনে করছে। মেয়ের যদি ক্ষতি হয়!! এসবের পেছনে মুখ্য কারণ তারা মনে করেন সৃষ্টিকর্তার অসন্তুষ্টতা। এই যুক্তি বাড়িওয়ালাদের কানেও গেছে। হক বন্ধু অবশ্যই কিছু বলছে বাড়িওয়ালিকে। সারাদিনই গল্প করতে দেখা জায় দুইজনকে। যাকে বলে গলায় গলায় ভাব। সেজন্যই গত মঙ্গলবার বাড়িওয়ালি বলল সাথে? -আপনারা বাড়ি থেকে এসে অনেকদিনই তো হলো। গন্ডগোল নাকি বাড়ির লোকদের -না।গন্ডগোল হবে কেনো?ছুটি হচ্ছে না ওনার।
-ও। যান। অল্পের মধ্যে ঘুরে আসুন ভালো লাগবে। শীতের পিঠেপুলিও খেয়ে আসবেন। আমাদের গ্রামের বাড়িটা বিক্রি করে দিছি। না হলে প্রত্যেক শীতে বাড়িতে যাইতাম। অল্পের মধ্যেই যান।
শিউলি ‘অল্পের মধ্যেই’ কথাটা বুঝতে পেরেছিল। এটা দিয়ে তিনি শুক্রবারের আগের কথাই বুঝিয়েছেন। মেয়ের বিয়েতে রিস্ক রাখতে চান না। অলক্ষণমুক্ত। এটা অবশ্যই বাড়াবাড়ি। রহমান সাহেবরা কি মানুষ না!
শিউলি খেলা দেখছে। বজলু রিংকুর চেয়ে ছোট। এরই সুযোগ নিচ্ছে রিংকু। হঠাৎ শিউলির চোখ গেলো রাস্তায়। রাস্তাটা বেশ চওড়া। ফুটপাতও ভালোই চওড়া। ফুটপাতের পাশ ঘেঁষে বসার ব্যবস্থাও আছে। প্রতি বুধবার এক বৃদ্ধা দম্পতি এসে বসে ওখানে। এদের নিয়ম কখনো ভঙ্গ হয় না। প্রতি বুধবার। আজকে শাল জড়িয়ে এসেছেন দুই জনেই। কি যে গল্প করে করছে দুজনে। মাঝেমধ্যে হাসাহাসিও করছে। ওরাওকি শেকলহীন? না।তা হবার কথা নয়। গত বুধবারেই এক যুবতীকে নিয়ে এসেছিল। নিশ্চয় নাত্রি হবে। তারা বসে বসে ব্যস্ততম রাস্তা দেখে। মানুষদের চলাফেরা দেখে। মাঝেমধ্যে খুনসুটি করতেও দেখা যায়। আজ দম্পতি একা এসেছেন। তাতে আনন্দে ভাটা পড়েনি।
সবার বৃদ্ধবয়স একই নয়। অবুঝ সময় বোঝে না তার উপস্থিতি প্রতিটি মানুষের মধ্যে ভিন্ন অনুভূতির জন্ম দেয়। বুঝলে প্রকৃতির সাথে হয়ত বোঝাপড়া করে নিত। ফুটপাতের বেঞ্চিতে বসা বুড়োরা অল্পতেই অভিমান করবে। তাদের অভিমান ভাঙানোর লোকের অভাব নেই। নাত্নি গালে হাত বুলিয়ে অভিমান ভাঙাবে। ওষধ না খেলে শাসন করে খাওয়াবে। বছর পরপর জেদ ধরবে ফ্যামিলি ট্যুর জন্য। ছেলেমেয়েরা সযত্নে নিয়ে যাবে চড়ুইভাতিতে। পুতুলের মতো নতুন নতুন কাপর সজ্জিত, শিশু যেন দুজনে। আর শিউলিদের বুড়ো বয়স হবে নিশ্চুপতায় ঠাসা। রাগ ভাঙানোর কেউ নেই। নেই কেউ জেদ মেটানোর। নিশ্চুপ জীবন। যেখানে সামান্য চিৎকার অসামান্যে রূপ নেয়। আপাতদৃষ্টিতে সদৃশতা দৃশ্যমান হলেও (বাইরে থেকে পার্থক্যহীন) প্রকৃতপক্ষে পার্থক্য অতলে ঠেকেছে।
হঠাৎ একটি মটর-সাইকেল মেইন রাস্তা থেকে বাসার সামনের রাস্তায় ঢুকছে। সূর্য ডোবা ডোবা। সোনালী আলোয় রহমান সাহেবের চোখ দেখা যাচ্ছে হেলমেটের ভেতর থেকে। এত আগে তো আসেন না! হর্ন দিলেন তিন বার। মন খুশি বোধ হয়। সূত্রটা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নি। অনুকল্প হিসেবেই আছে। হর্ণের শব্দে ভয়ে বাচ্চারা খেলা বন্ধ করে দিয়েছে। একবার তাকিয়েছেন বেলকুনিতে। বাসায় এসে গোসল করলেন। সূত্রমতে মন ভালো। নাস্তা খেতে বসে বললেন কথাটা। ছুটি পাওয়া গেছে দুই দিন। সরকারি ছুটি। অতিরিক্ত এক দিন তিনি ব্যবস্থা করেছেন। আজকে রাতে বাইরে ডিনার করবেন। ভাবছেন বেড়াতে যাবেন কোথাও। কোথায় যাবেন সিদ্ধান্ত শিউলির। শিউলির মুখে মুচকি হাসি স্পষ্ট। চোখে আনন্দ স্পষ্ট। মনে মনে ভেবেও নিয়েছে কোথায় যাবে। বাড়িতে নয়। বাড়িতে কবিরাজী ব্যস্ততা। কুসংস্কার। পাহাড় দেখতে যাবে। যেখানে লোকচক্ষু নেই প্রায়। প্রকৃতির চোখ উন্মুক্ত। মানুষ থেকে তিন দিন দূরে থাকার আনন্দ। পাহাড় থেকে আকাশ যেমন কাছে মনে হয় তেমনি বিশালও মনে হয়। নীল বোধ হয় বিশালতার প্রতীক। আকাশের বিশালতায় নীল। সমুদ্রের বিশালতায় নীল। শিউলির বিশালতা পছন্দ। এজন্যই হয়তো শিউলির প্রিয় রঙ নীল!!
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!