সেপ্টেম্বর ৬,১৯৭৬....
সোভিয়েত বিমানবাহিনীর মহড়া চলছে ,ভোর থেকেই শুরু হয়েছে মহড়া। পাইলটরা যার যার এয়ারক্রাফট নিয়ে আকাশে ফর্মেশন করে দাগ কেটে যাচ্ছেন। ২৯ বছর বয়সী সোভিয়েত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট Viktor Ivanovich Belenko তার বিশালাকার এয়ারক্রাফট নিয়ে উড়াল দিলেন নীল আকাশে, সাথে তার উইংম্যানরা ও আছেন। ফাইটারটিতে কোনো অস্ত্র না থাকলেও ফুয়েল ট্যাংক ফুল লোডেড আছে। ড্রিল চলাকালে হঠাৎ করে ফর্মেশন ভেঙে উধাও হয়ে গেলেন Belenko এবং তার ফক্সব্যাট ফাইটার। সোভিয়েত এয়ার ফোর্সের রাডার ট্র্যাক করতে পারছে না তাকে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে নাকি কারনটা ইচ্ছাকৃত, আসলে আকাশে ঘটেছে টা কি.... এই নিয়ে সোভিয়েত অফিসাররা পড়েছেন গভীর চিন্তায়!
তবে বেলেঙ্কো উড়ে চলেছেন সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের দিকে, যেদিকে আসলে তার কখনোই ভুল করেও যাওয়ার কথা নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের মাত্র ১০০ ফুট উপর দিয়ে উড়ে চলেছেন যেন সোভিয়েত বা জাপানি রাডারের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে তার বিশালাকার ফাইটারটি। এভাবেই কয়েক মিনিটের মধ্যে সুপারসনিক স্পিডে ঢুকে গেলেন জাপানি সমুদ্রসীমায়। তারপর হঠাৎ করে ৭৫° অ্যাঙ্গেল অফ অ্যাটাকে ভার্টিক্যাল ক্লাইম্ব করে ২০,০০০ ফুট উচ্চতায় উঠে গেলেন মুহূর্তেই। এসময় তাকে প্রায় ৮-৯ জি সহ্য করতে হয়েছে, অর্থাৎ তার ওজনের আট-নয় গুন বেশি। এরপর ২০,০০০ ফুটে উড়তে শুরু করলেন বেলেঙ্কো। ইতিমধ্যেই আকস্মিকভাবে জাপানি ATC তে এলার্ম বেজে উঠল, রাডারে দেখা যাচ্ছে অজানা কোনো এক এয়ারক্রাফট শূন্য থেকে হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয়েছে জাপানি আকাশ সীমায়। অফিসাররা হকচকিয়ে গেছেন, আরে কি হলো ব্যাপারটা! UFO এর মতো যেন মহাকাশ থেকে হঠাৎ উদ্ভব হয়েছে কোনো এলিয়েন শীপের। ATC থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে সেই অজানা এয়ারক্রাফটের সাথে যোগাযোগ করার, কিন্তু কোনো রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে না। তাই মূহুর্তের মধ্যে দুটি জাপানি এয়ার ফোর্সের F-4EJ Phantom ফাইটার স্ক্র্যাম্বেল করল অজানা এয়ারক্রাফটকে ইন্টারসেপ্ট করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ততক্ষণে বেলেঙ্কো মেঘের মধ্যে আবারও হারিয়ে গেছেন রাডার থেকে। এক জোড়া ফ্যান্টমের রাডারও ট্র্যাক করতে ব্যর্থ হলো তাকে। আসলে ফক্সব্যাট ছিলই শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে মিশন এক্সিকিউট করার জন্য, তাই এসব ওর কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিছুক্ষণ পর জাপানের হাকোডেট এয়ারপোর্টের আকাশে দেখা গেল এক দৈত্যাকার ফাইটার বিমান চক্কর কাটছে আর গর্জন করছে ইঞ্জিন দুটো, গাঢ় ধূসর রঙের বিশালাকার দেহের সাথে সোভিয়েত লাল তারকা খোঁচিত চিহ্ন। পশ্চিমারা কখনোই দেখিনি এই দৈত্যকে! যেন রূপকথার কোনো এক চরিত্র, পশ্চিমাদের দুঃস্বপ্নের কোনো এক দৈত্য। বেলেঙ্কো ডিসেন্ড করে এগিয়ে আসছে রানওয়ের দিকে। কিন্তু এই দৈত্যের ল্যান্ডিংএর জন্য হাকোডেটের রানওয়ে যথেষ্ট লম্বা নয়। টাচডাউনের পর রানওয়ের একদম শেষ প্রান্তে গিয়ে কোনোভাবে থামলো বিমানটি; প্যারাসুট খুলে, ল্যান্ডিং গিয়ারের টায়ার ব্রাস্ট হয়ে। জাপানি অফিসাররা শুধুই দেখছেন অবাক হয়ে! এতক্ষনে যেন তারা বুঝতে পারলেন তাদের আকাশে কোন ফাইটার অনুপ্রবেশ করেছিল। তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না তারা যা দেখছেন। কারণ এটি ছিলো তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে গোপনীয় ফাইটার-ইন্টারসেপ্টর এয়ারক্রাফট Mikoyan Gurevich MiG-25 Foxbat, যেটা সম্পর্কে জানতে CIA এর অফিসাররা তথা পশ্চিমারা এত বছর ঘাম ঝরিয়েও তেমন কিছু সুবিধা করতে পারেনি। আর সেই এয়ারক্রাফট নিজে থেকেই তাদের কাছে এসে ধরা দিয়েছে! ল্যান্ড করার পর চারদিক দিয়ে ধোয়া উঠছে, এর মাঝেই ক্যানোপি খুলে গেল। ঝাপসা দৃশ্যপটে দেখছে সবাই, ককপিট থেকে বেরিয়ে আসলেন এক সোভিয়েত ফাইটার পাইলট, বেলেঙ্কো। আকাশের দিকে দুটো ওয়ার্নিং ফায়ার করে, হাত উঁচু করে ঘোষণা করলেন তার পক্ষত্যাগের কথা। জাপানি মিলিটারির হেফাজতে নেওয়া তাকে। আর ল্যান্ডিং এর পর ফাইটার টিকে নেওয়া হলো কাছের একটি জাপানি এয়ারবেস এ। সেখানে আমেরিকান ইঞ্জিনিয়াররা ভালো মতোই কাটাছেঁড়া করে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করলেন ফাইটার টির।
যদিও এই ঘটনার আগে ১৯৭০ এ পশ্চিমারা শুধু আন্দাজ করেছিল যে সোভিয়েতরা কিছু বড়সড় একটা বানিয়েছে, যা তাদের স্যাটেলাইটে ধরা পড়েছিলো। চওড়া ফিউসিল্যাজ, বিশাল উইংস্প্যানের কোনো ফাইটার যা শব্দের চেয়ে তিনগুণ বেশি গতিতে উড়তে পারে, এর সর্বোচ্চ গতি মাক ৩.২। এছাড়া ১৯৭১ এর মার্চে ইজরাইল একটা এয়ারক্রাফট ট্র্যাক করে যা ম্যাক ৩.২ গতিতে উড়ছিলো প্রায় ৬৩,০০০ ফুট উপর দিয়ে,যদিও তখন তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হারিয়ে যায়। কারণ তখন এমন কোনো সোভিয়েত এয়ারক্রাফট ছিল পশ্চিমাদের কল্পনার বাইরে। মোসাদ, সিআইএ এর টপ এজেন্টরা তন্যতন্য করে খোঁজাখুঁজি করেও কোনো দিশা পাচ্ছিলেন না জিনিসটা আসলে কী ছিল আর কেন ছিল!
এদিকে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির ফলে নভেম্বরে একবার একটি ইজরাইলি ফাইটার একে ইন্টারসেপ্ট করার জন্য আকাশে উড়ে, যদিও পাইলট বা কন্ট্রোল রুমের কেউই জানতো না তাদের আসলে কি ইন্টারসেপ্ট করতে হবে। অজানা সেই এয়ারক্রাফটের দিকে ৩০,০০০ ফুটে গিয়ে আন্দাজে মিসাইলও ফায়ার করে ফাইটারটি যদিও মিসাইলের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেই আকাশে মিলিয়ে যায় সেই অজানা এয়ারক্রাফটটি। এমন কয়েকটি ঘটনার পর যখন জাপানে ফাইটারটি ল্যান্ড করলো, দুইয়ে দুইয়ে চার করে ফেললো পশ্চিমারা, যে এটাই ছিলো সেই অজানা, দৈত্যাকার এয়ারক্রাফট।
যদিও পরবর্তীতে MiG-25 কে নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার পর পশ্চিমারা বলে এটা তেমন বিশেষ কোনো এয়ারক্রাফট না, বরং সাধারণ একটা এয়ারক্রাফট। তাই একে নিয়ে চিন্তার কারণ নেই! ব্যাপারটা নিতান্তই হাস্যকর, কারণ যা রহস্য বা শক্তিমত্তা জানার বা যা দেখার , সব দেখে শুনে এখন এসে বলে দিলাম ভালো না এটা, এটার সব শক্তি আমরা জানি, আর হয়ে গেলাম আমরাই সেরা। (অথচ এই ঘটনার আগে এই এক ফক্সব্যাটই কোল্ডওয়ার এরায় পুরো পশ্চিমা বিশ্বের কর্তা ব্যক্তিদের ঘাম ছুটিয়েছে বছরের পর বছর)
যাই হোক, এরপর MiG-25 কে টুকরো টুকরো করে চল্লিশটা! (আসলেই) কন্টেইনারে প্যাক করে সোভিয়েতে ফেরত পাঠানো হয়। আবার জাপান ৪০,০০০ ডলার ক্ষতিপূরণ ও নিয়েছিল সোভিয়েতদের থেকে শিপিং এবং রানওয়ে রিপেয়ারিং এর খরচ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বি লাইক -"মানে ভাই আমার কোনো লাভ লস নাই,আমার লাইফই লস" ফাইটার ও গেল, পাইলট ও গেল, টাকাও উল্টা গচ্চা গেল!
আর পরে সেই পাইলট আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়ে USAF এর অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
এভাবে একজনের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে গোপনীয় ফাইটার এয়ারক্রাফটের সকল নাড়ি নক্ষত্র জেনে গিয়েছিল পশ্চিমারা। পরে এর উত্তরসূরী MiG-31 Foxhound আসলেও ফক্সব্যাট যেমন সাড়া ফেলেছিল তেমন ইমপ্যাক্ট ফক্সহাউন্ড আদতে ফেলতে পারেনি। যদিও ন্যাটো আর রাশানদের মধ্যে গোল্লাছুট খেলা এখনও চলেছেই ফাইটার আর বোম্বার নিয়ে।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!