বাংলা সহপাঠ শিক্ষাকে অবাঞ্ছিত বলিয়া স্কুল জীবনে শুধু পরীক্ষায় উত্তরণের নিমিত্তে আনমনে বাংলা সাহিত্যের গদ্য ও পদ্য পড়া মানুষের জীবন ক্ষণে উহাকেই যে এত আপন করিয়া ফেলিবে তাহা কে বা জানিত। সাহিত্য প্রেমের কল্যাণে পথে ঘাটে চলিবার সময় লিখিবার মতো বিভিন্ন উপমা হঠাৎ করিয়া মনের কোণে জাগিয়া ওঠে এবং তাহা পথেই মিলিয়া যায়। নয়তো অদ্য লিখিবই বলিয়া যদি কোন মনোহর উপমা শক্ত করিয়া ধরিয়া শয়ন কক্ষ পর্যন্ত টানিয়া লইয়া আসি, একাডেমিক পড়াশোনা, অ্যাসাইনমেন্ট, নতুবা পরিপার্শ্বের পড়াশোনার দোলে উহা চিরদিনের জন্য ঘুমাইয়া পড়ে। যাহাকে পরবর্তীতে হাজার স্মৃতিচারণেও জাগ্রত করা হইয়া ওঠে না।
বেন্ডিং মোমেন্ট ডায়াগ্রাম, কংক্রিট এর কমপ্রেস্সিভ স্ট্রেংথ বিশ্লেষণী যান্ত্রিক মস্তিষ্ক সামান্য আয়েশেই লেখালেখির মতো শৈল্পিক বিষয়গুলো উপলব্ধি করিতে পারে না। পরের দিনের ক্লাস টেস্ট, ল্যাব রিপোর্ট, একগাদা অ্যাসাইনমেন্ট এর দুশ্চিন্তা লইয়া ঘুমাইতে যাওয়া ক্লান্ত চোখ চাহিলেই দেখিতে পারে না জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে শ্রীকান্ত ইন্দ্রের ডিঙি চালাইয়া মৎস্য চুরি স্বপ্ন।
তবুও আজিকে লিখিতে বসিয়াছি। কারণ টার্ম ব্রেক এর ছুটির অপরাহ্নে আসিয়া আবার কবে লিখিবার সুযোগ হইবে ইহা ভাবিয়া ব্যাপক মনোকষ্ট হইতেছিল। এই ধরাছোঁয়াতীত ভয়ংকর মনের তুষ্টির জন্যই আজিকে লিখিতে বসিয়াছি।
কিন্তু কোন বিষয়েই বা লিখিব? তবে শহুরে কোন বিষয়ে যে লিখিবো না, ইহা সুস্পষ্টভাবেই বলিতে পারি। কারণ আমাদের ছোট্ট ক্যাম্পাসের অনেক জায়গা আছে আমি সেভাবে চিনিয়া উঠিতে পারি নাই, ইহা নিয়ে অনেকে ঠাট্টা-উপহাসও করে বটে। সেখানের পরিবেশ সম্পর্কে আমার কতটুকু জ্ঞান হইয়াছে তাহা সহজেই বুঝিয়া লইয়া যায়। বলিতে পারেন শুধুমাত্র তিরস্কৃত হওয়ার ডরেই আমি সে বিষয়ে দাঁড়ি টানিয়া দিলাম।
দীর্ঘ পাঁচ বৈকি সাড়ে পাঁচ মাস পর বাড়িতে গিয়াছিলাম কয়েক দিনের অবকাশে। বাংলার ষড়ঋতুর মধ্যে যদি আমাকে একটি বাছিয়া লইতে বলা হয় তাহলে নির্দ্বিধায় হেমন্তকালকেই নির্ধারণ করিয়া বসিবো। আরো সুস্পষ্ট ভাবে বলিতে গেলে হেমন্তের শেষে শীতের ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রকৃতি সবচেয়ে মায়াবীরূপ ধারণ করে, যাহা একান্তই পাথুরে ব্যক্তি ব্যতীত সকলকে আকর্ষিত করিবেই করিবে। যাহাই হউক, প্রায় তিন বছর পর এমন একটি সময় দেখিতে পারিয়াছি বলিয়া ব্যাপক আনন্দিত হইয়াছি। অনেকেই আবার ইহা ভাবিয়া ভুল করিতে পারেন যে, এই তিন বছর কি তাহলে বাংলা ত্যাগ করিয়া অন্য ভূমিতে অবস্থান নিয়াছিলাম যাহার নিমিত্তে আমার হেমন্ত দর্শন ব্যর্থ হইয়াছে?
আসলে শহুরে পরিবেশে শীত এবং বর্ষা সুস্পষ্টভাবে পৃথক করা গেলেও বাকিগুলো আলাদা করা কঠিন হইয়া পড়ে। শরতের কাশফুল, হেমন্তের সোনালী ধানক্ষেত, বসন্তের কোকিল--এখানে তো সবই অনুপস্থিত।
গ্রাম থেকে দূরে থাকিলে উহাও যে দর্শনীয় স্থান হইয়া পড়ে তাহা বড়ই সত্য। যাহারা সৌন্দর্য উপভোগ করিতে পারে তাহারা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেনা। অন্যভাবে বলিতে গেলে যাহারা সৌন্দর্য সৃষ্টিতে অবদান রাখিয়া যায় তাহারা তাহা উপভোগ থেকে স্পষ্টতই বঞ্চিত হয়। তাই সেই অভূতপূর্ব সৌন্দর্য এর অনেকাংশ অগোচরেই থাকিয়া যায় পল্লীবাসীদের নিকট।
কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের খেজুরের রস বিক্রেতার সুমধুর দৃশ্য আমাদের নিকট কতই না উপভোগ্যকর। অনেকে তাহা পরবর্তীতে স্মৃতিচারণের জন্য ক্যামেরাবন্দি করিয়া লয়। কিন্তু কোন প্রকৃতিপ্রেমিক যদি রস বিক্রেতার নিকট তাহার সৌন্দর্য রূপ বর্ণনা করিতে যায়, প্রত্যুত্তরে তিনি যে কণ্টকাকীর্ণ, শক্ত, নীরস রকমের জবাব পাইয়া ফিরিয়া আসিবেন তাহা নিঃসন্দেহে বলিতে পারি।
দলবেঁধে ধান কাটার মনোরম দৃশ্য কোন মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা দেখিয়া অনেক সুখ লাভ করিতে পারেন। তবে শ্রমিকদের এই সৌন্দর্য সৃষ্টিতে কাটানো সময়গুলো যে কতটুকু সুখকর তাহা আর বলিতে পারিব না। যাহাই হউক, আমি যেহেতু সৌন্দর্য সৃষ্টিতে অবদান রাখিবার কেহই না। তাই আমিও যে সেগুলো যথেষ্ট উপভোগ করিয়াছি সেটা বলিতেই পারি। সকালের কোমল রোদে দাঁড়াইয়া মুখরোচক কিছু খাইতে খাইতে পাড়ার ছেলেদের সহিত এলোমেলো গল্প করার মুহূর্তগুলি যে কতই সুমধুর বলিয়া শেষ করা যাইবে না।
যাহারা শহর থেকে বহুদিন পরে বাড়িতে যাইয়া থাকে তাহাদের প্রতি পাড়ার ছোট বাচ্চাদের কেমন যেন একটা কৌতূহল দেখিতে পাওয়া যায়। সকাল হতে না হতেই দেখা যায়, নয়া ব্যক্তির বাড়ির আশেপাশে তাহারা জড়ো হইয়া অপেক্ষায় থাকে এবং তাহাদের কাছে যাওয়ার সাথে সাথেই কে কতটুকু ক খ, এক দুই, এ বি সি ডি, পারে সেই প্রতিযোগিতা করিতে থাকে।আপন ভাতিজার মুখ থেকে কখনো কাকা আবার কখনো ভাইয়া ডাক শোনার সৌভাগ্য বোধহয় তাহাদেরই হয়, যাহারা বিশেষ কোনো কারণে পরিবার থেকে দূরে থাকে।
পাড়ার ছেলেদের সহিত হেমন্তের বিকেলে মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি যেন সহজে মুছিবার নয়। বিকেলে সোনালী ধানক্ষেতে সোনালী রোদ, মাঠের শেষ প্রান্তে সূর্য অস্তমিত হওয়া, পাখিদের নীড়ে ফেরা, সৌন্দর্য সৃষ্টিতে কোনটি অধিক অবদান রাখিয়াছে এই প্রশ্ন করিলে কে-ই বা বিব্রত হইবে না?
অতঃপর সূর্যের লালিমা দিগন্তে মিশিয়া যাইবার পরে আমরা নিত্য ঘরে ফিরিতাম।।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!