ছাত্ররাজনীতির করাল থাবা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কতবার আঘাত হেনেছে এবং এর কারণে যে অকালে কত নিরপরাধ, মেধাবী প্রাণ ঝরে গেছে, লোভ, দম্ভ এবং পশুত্বের দাগ পড়তে পড়তে কালো হয়ে গেছে কত স্বচ্ছ, নিষ্পাপ আত্মা-তা ভাবলেও চোখে আসে জল, কেঁপে ওঠে হৃদয়। আজ বুয়েটে কোনো লেজুড়বৃত্তিক বা সাংগঠনিক রাজনীতি তো দূরের কথা, ব্যক্তিপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের রাজনীতির চর্চা এবং র্যাগিংসহ শিক্ষার্থীদের সবধরণের শারীরিক-মানসিক লাঞ্ছনাও সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত।
ছাত্ররাজনীতির ভয়াবহতার ফলে যে প্রাণগুলো পৃথিবী থেকে ঝরে গেছে চিরতরে, তার ক্ষতি অপূরণীয়। তারপরেও বুয়েট প্রশাসনের সান্ত্বনা, ভরসার হাত সবসময়ই থেকে এসেছে নিহতদের পরিবার-প্রিয়জনদের কাঁধে। এবারও হয় নি তার ব্যতিক্রম।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নিহত আরিফ রায়হান দীপের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। সোমবার (৭ আগস্ট, ২০২৩) এ আর্থিক সহায়তা প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সোমবার বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদারের হাত থেকে আর্থিক সহায়তার চেক গ্রহণের পর কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন দীপের বাবা শেখ আলী আজম। তিনি বলেন, ‘বুয়েটের পক্ষ থেকে যেই সহায়তা প্রদান করা হয়েছে সে জন্য ধন্যবাদ। বুয়েটে এলে দীপের ঘ্রাণ পাই এখনো।’ চেক প্রদানের সময় বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, আমরা চাইনা এভাবে বুয়েটের কোনো শিক্ষার্থীর প্রাণ যাক। বুয়েটের প্রতিটি হলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখন জোরদার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জরুরি প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা যেন আমাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন, সে বিষয়েও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
এছাড়াও সাবিকুন নাহার সনির পরিবার কেউ ৫০ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা রয়েছে, ইতিমধ্যে ১০ লক্ষ টাকা হস্তান্তর করা হয়েছে বুয়েট প্রশাসনের পক্ষ থেকে, খুব শীঘ্রই বাকি ৪০ লক্ষ টাকা প্রদান করার কথা রয়েছে। বুয়েট প্রশাসন এবং বুয়েটের একটি ছাত্রী হলের নামকরন ও করা হয় তার নামে।
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আরিফ রায়হান দীপ নজরুল হলে নিজ কক্ষে হওয়া, বুয়েটেরই আরেক শিক্ষার্থী ও হেফাজতকর্মী মেজবাহ উদ্দিনের চাপাতির নৃশংস হামলার ফলে ৮৪ দিনের মৃত্যুর সাথে লড়ে অবশেষে ২ জুলাই পরাজয় স্বীকার করে নেন। এই বর্বর ঘটনারই দশ বছর পর বুয়েট কর্তৃপক্ষ দীপের পরিবারকে ৫০ লক্ষ টাকা অনুদান দেবে এবং এই হত্যা মামলা পরিচালনায় দীপের পরিবারকে সহায়তা প্রদান করবে বলে জানা যায় ২ জুলাই, ২০২৩ ইং তারিখে দীপের দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে আয়োজিত “স্মরণে দীপ” শীর্ষক ভার্চুয়াল স্মরণসভায়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের সাবেক ছাত্রনেতারা। একই সভায় বক্তাদের নিকট থেকে জানা যায়, সাবেকুন নাহার সনির পরিবারকেও ৫০ লক্ষ টাকা আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে।
২০০২ সালের ৮ জুন টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে বুয়েটে ছাত্রদলের দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। ফলাফলস্বরূপ ক্রমাগত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে হত্যাকাণ্ডের মামলার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করা হয় এবং মামলার রায়ে দুই পক্ষের নেতা মুকিত ও টগরসহ মোট তিনজনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।
২০২১ সালের জুলাই মাস থেকে প্রতিমাসে ৭৫ হাজার টাকা করে ১২ বছর আর্থিক অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, এবং আদালতে চলমান মামলার সকল খরচ বহন করছে বুয়েট প্রশাসন। এ প্রসঙ্গে বুয়েটের উপাচার্য ড. সত্যপ্রসাদ মজুমদার জানান যে ‘গত ১ জুলাই,২০২১ থেকে আবরারের পরিবারকে প্রতিমাসে ৭৫ হাজার টাকা করে দিয়ে আসছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। আগামী ১২ বছর এই পরিমাণ অর্থ প্রতিমাসে তার পরিবারকে দেওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আবরারের পরিবারের পক্ষ থেকে যেটুকু সাহায্য চাওয়া হয়েছে, তা আমরা দিয়েছি। আমরা মাসিক সাহায্য করছি। ওনারা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার পরে জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে প্রতিমাসে ৭৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আইনি সহায়তা ও আইনজ্ঞ ফি, সাক্ষীসহ আনুষঙ্গিক খরচ, এমনকি তাদের ঢাকায় এসে থাকার খরচও বুয়েট থেকে বহন করেছি।’
২০১৯ সালে ৭ অক্টোবর ভোরে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের সিঁড়িতে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের নিথর দেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় বুয়েট প্রশাসনের পক্ষ থেকে থানায় করা সাধারণ ডায়েরি এবং আবরার ফাহাদের পিতা বরকতউল্লাহর চকবাজার থানায় দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দুই বছর দুই মাস পর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালত আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিনসহ ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং আরও পাঁচ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে আর কখনো যেন সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি, সন্ত্রাসবাদ-র্যাগিংয়ের মত অপরাধ ফিরে না আসে, আর কোনো নিরপরাধ প্রাণকে যেন অকালে ঝরে যেতে না হয় ক্যাম্পাস থেকে-এই অঙ্গীকারে বর্তমানে বুয়েট শিক্ষার্থীরা একতাবদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!