আজ ৮ই জুন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসের অন্যতম এক কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয় একুশ বছর আগে এইদিনে। বাকিসব স্বপ্নবাজ তরুণের মতই বিশ্বজয়ের অদম্য লক্ষ্য নিয়ে এ বুয়েটে প্রবেশ করেছিলেন কেমিকৌশল বিভাগের ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। ২০০২ সালের এই দিনে বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের দুইদলের মধ্যকার সংঘর্ষ এবং গোলাগুলিতে প্রাণ হারান এই মেধাবী শিক্ষার্থী।
তৎকালীন বুয়েট এলাকায় অন্যতম তৎপর দুইটি ছাত্রদল গ্রুপ ছিল বুয়েট ছাত্রদলের মুকী গ্রুপ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এস.এম. হল ছাত্রদলের টগর গ্রুপ। টেন্ডারবাজি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে উক্ত গ্রুপদ্বয়ের মধ্যকার বিরোধ ছিল প্রকাশ্য। সেই সময় পলাশী এলাকায় চাঁদাবাজ হিসেবে ত্রাস হয়ে আবির্ভূত হয় এস. এম. হলের টগর এবং তার অনুসারীরা। অন্যদিকে বুয়েটের তৎকালীন ছাত্রদল সভাপতি ছিল মোকাম্মেল হায়াৎ খান ওরফে মুকী, কেন্দ্রীয় ছাত্রদল যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদটিও যে কিনা নিজের করে নিয়েছিল। মুকী ছিল চট্টগ্রামের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের ওরফে সাকা চৌধুরির অনুগত এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রদল সভাপতি পিন্টুর কাছের ছোট ভাই।
২০০২ সালে বেশ বড় অঙ্কের একটি টেন্ডারকে কেন্দ্র করে টগর-মুকীর দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। ৮ জুন বেলা পৌনে একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত দুই গ্রুপ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং তিতুমীর হল এলাকায় মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করে। একই সময়ে স্বাপ্নিক ‘৯৯ ব্যাচের লেভেল পূর্তি উপলক্ষ্যে শিক্ষার্থীরা উদযাপনের প্রস্তুতির জন্য ক্যাম্পাস এলাকায় অবস্থান করলেও প্রথম দফা গোলাগুলি শুরু হলে তারা নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান। প্রথম দফা গোলাগুলি বন্ধ হলে আহসানউল্লাহ হলে অবস্থান নেওয়া সাবেকুন নাহার সনি বেরিয়ে আসেন। এ বের হয়ে আসাই যেন তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। আচমকা দ্বিতীয় দফা গোলাগুলি শুরু হলে সনি তার মাঝে পড়ে যান। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। আনুমানিক আধা ঘণ্টা পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হত্যাকাণ্ডের রাতেও খুনিরা বুয়েটের ড. এম এ রশীদ হলে অবস্থানরত ছিল। বিক্ষুদ্ধ শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রশীদ হল ঘেরাও করে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানালেও প্রশাসন ছিল নির্লিপ্ত। উলটো শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনের কৌশল হিসেবে পরদিন, ৯ জুন, ২০০২ তারিখ বুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতেও দমানো যায়নি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের, সারাদেশজুড়ে অব্যাহত থাকে আন্দোলন।
তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখায় আন্দোলনকারীদের প্রতি এক কুৎসিত ষড়যন্ত্র, যা কিনা বুয়েট ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকার এক সময়। খুনিদের বিষয়ে নমনীয়তা প্রদর্শন করলেও, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে তারা। একজন সহপাঠী, একজনের বোনের হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়ার দাবিতে আন্দোলনের ফলস্বরূপ বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করা হয় আন্দোলনকারীদের। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় বিজয় শংকর তালুকদার বিশু, সুব্রত সরকারকে বহিষ্কার করা হয়। এ শাস্তির মূল উদ্দেশ্যই ছিল ভীতিপ্রদর্শনপূর্বক আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেওয়া।
প্রায় ২ মাস পর বুয়েট খোলার সাথে সাথেই আন্দোলন পুনরায় দুর্বার রূপ ধারণ করে। সারাদেশ জুড়ে ক্রমাগত আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সনি হত্যা মামলার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করা হয়। মামলার রায়ে সন্ত্রাসী মুকী, টগরসহ তিনজনের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। উক্ত মামলাই ছিল বাংলাদেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রথম বিচার।
মূল আসামীদের মাঝে অন্যতম মুকী পলাতক থাকা অবস্থাতেই ট্রাইব্যুনাল-১ আদালতের বিচারপতি শাহেদ নুরুদ্দীন ২০০৩ সালের ২৯ জুন টগর-মুকীর ফাঁসির আদেশ দেন। পরবর্তীতে আসামীপক্ষের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালের ১০ মার্চ হাইকোর্ট মুকী, টগর ও সাগরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী মোকাম্মেল হায়াৎ খান মুকী তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অস্ট্রেলিয়ায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। পলাতক রয়েছেন নুরুল ইসলাম সাগর ওরফে শুটার নুরু; টগর রয়েছেন জেলে।
প্রায় দেড়যুগ আগে সনির স্মৃতিফলক গড়েছিল বুয়েট প্রশাসন, যাতে রয়েছে সনির ডায়েরি থেকে নেওয়া লেখা-
“এই আমি খুব আবেগপ্রবণ
এই আমি খুব জেদী
এই আমি খুব ছেলেমানুষ
এই আমি কিছুটা বাস্তব
এই আমি খুব একা।”
বুয়েট শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে বুয়েট ছাত্রীহলের নামকরণ করা হয় ‘সাবেকুননাহার সনি হল’। ২০২১ সালের ২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৫২৬ তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে বিদ্যমান ৪ তলা ছাত্রী হলকে 'সাবেকুন নাহার সনি হল' নামকরণ করা হবে।
বুয়েটের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে সাবেকুন নাহার সনি হত্যা। বুয়েট শিক্ষার্থীরা মনে করে ক্যাম্পাস এলাকায় লেজুরবৃত্তিক রাজনীতির চর্চা এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাস কখনই কাম্য নয়। বুয়েট শিক্ষার্থীরা এখনো আশা করে, সনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে তাদের শাস্তি বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা হবে; সুস্থ-শান্ত-নিরাপদ হয়ে উঠবে প্রতিটি ক্যাম্পাস।
মন্তব্যসমূহঃ
▶ Hasibul Islam • hasiee8004@gmail.com • Aug. 15, 2023, 3:16 p.m.
😭😭