আরেকটি ভুল চিকিৎসা। ঝরে গেলো আরো একটি তাজা প্রাণ। কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড়ে অবস্থিত গোমতী হাসপাতালে Anal Fissure বা মলদ্বারে ঘা সংক্রান্ত একটি অপারেশনের সময় ভুল চিকিৎসায় মেহেদী হাসান নামের এক প্রাক্তন বুয়েট শিক্ষার্থী মৃত্যু হয়। তিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় পিএইচডি গবেষণারত ছিলেন।
ভুক্তভোগীর পরিবারেই ভাষ্যমতে, এই অপারেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক, গোমতী হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. আবু বকর ছিদ্দিক ফয়সাল এই ঘটনায় তার ভুল স্বীকার করেছেন।
মৃতের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি জুন মাসের ২০ তারিখে, পূর্ব নির্ধারিত Anal Fissure সংক্রান্ত অপারেশনের জন্য মেহেদী হাসান গোমতী হাসপাতালে ভর্তি হন। সেইদিন ই তার অপারেশন হয় এবং চিকিৎসক অপারেশন 'সাকসেসফুল' হয়েছে বলে দাবি করেন। অপারেশনের পর থেকেই রোগীর পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হয় এবং রোগী ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যেতে থাকেন। হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা এই ব্যথা কে অপারেশন- পরবর্তী ব্যাথা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তারা একের পর এক ব্যথানাশক ঔষধ ও ইঞ্জেকশন দেন এবং রোগীর স্বজনদের চিন্তিত না হতে বলেন। কিন্তু, রোগীর অবস্থা ক্রমশ আরো খারাপের দিকে গেলে ২১ তারিখ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে তাকে কুমিল্লা নগরীর সিডি প্যাথ হাসপাতালের আইসিউ তে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে, ২২ তারিখ দুপুরের দিকে আল্ট্রাসনোগ্রাম এর মাধ্যমে পূর্ববর্তী অপারেশন এর ভুল ধরা পড়লে রোগীর মুমূর্ষু অবস্থায়ই তাকে দ্বিতীয় বার অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অপারেশনের পর রোগীর জ্ঞান আর ফেরানো যায় নি। ২২ তারিখ বিকালেই মেহেদী হাসান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
মৃত মেহেদী হাসান কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চান্দলা ইউনিয়নের সবুজপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট আলী আক্কাসের ছেলে। গত ২৩ জুন তাকে নিজ বাড়ির পৈতৃক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের ২০০৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী। ঈর্ষণীয় একাডেমিক রেজাল্ট নিয়ে স্নাতক পাস করার পর তিনি কিছুদিন দেশের প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও আহ্ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে ছিলেন। তারপর, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ নিয়ে কানাডায় যান। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য এডমিশন নিয়েছিলেন তিনি। পিএইচডির শেষ বর্ষে থাকাকালীন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। এই ঘটনায় তার সহকর্মী, শুভাকাঙ্খী এবং সর্বোপরি পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
মৃত মেহেদী হাসানের ছোট ভাই, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন ও কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ কামরুল হাসান জানান, "ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় দীর্ঘ সাত বছর আমার ভাই দেশে আসতে পারেন নি। ২০১৩ সালের আগস্ট মাসের ২৬ তারিখ উচ্চতর ডিগ্রির উদ্দেশে কানাডায় পাড়ি জমান তিনি। দীর্ঘ সাত বছর পর, গতবছরের ২২ মে, করোনাকালীন বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফেরেন তিনি। পিএইচডি এর বাকি অংশটুকু দেশে থেকেই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের মাধমে সম্পন্ন করার অনুমতি পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিগত ২০ তারিখ, অপারেশনের জন্য আমার ভাই মেহেদী হাসান গোমতী হাসপাতালে ভর্তি হন। মাত্র ১০-২০ মিনিটের একটি ছোট্ট অপারেশন বলা হলেও প্রায় দু'ঘন্টা ধরে চলে অপারেশন। অপারেশনের পরেই আমার ভাইয়ের পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। কিন্তু হাসপাতাল এর চিকিৎসকেরা খুব একটা গুরুত্ব নিয়ে এই ব্যাপার দেখেন নি। শুধু পেইনকিলার আর ভারী ব্যথানাশক ইনজেকশন দিয়ে যান। প্রায় দুই দিন হাসপাতালে থেকেও অবস্থার আরো অবনতি হওয়ায় আমার ভাইকে ২১ তারিখ রাতে সিডি প্যাথ হাসপাতালের আইসিউ তে স্থানান্তর করি। ২২ তারিখ দুপুরে, চিকিৎসক আবু বকর ছিদ্দিক ফয়সাল এসে আল্ট্রাসনোগ্রাম করেন এবং বলেন যে, অপারেশনের সময় রোগির পায়ুপথের নালিতে একটি ফুটো তৈরি হয়েছে। সেই ফুটো দিয়ে শরীরের বর্জ্য পদার্থগুলো পেটের খালি অংশে জমা হওয়ায় এই তীব্র ব্যথার সৃষ্টি। তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় আমার ভাইকে আবার অপারেশন টেবিলে নিয়ে যান। কিন্তু সেই অপারেশন থেকে আমার ভাই আর ফিরে আসেন নি।"
মোহাম্মদ কামরুল হাসান আরো অভিযোগ করেন, হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে ঘটনাটি দেখলে, আরেকটু আগে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো গেলে হয়তো তার ভাইকে বাঁচানো যেতো।
মৃতের চাচাতো ভাই মোঃ পলাশ হাসান জানান, "মেহেদী ভাইয়ের মৃত্যুর পরই হাসপাতালের ডাক্তাররা সরে পড়েন। স্থানীয় সাংবাদিকরা এসে কথা বলতে চাইলেও তাদের কাউকে পাওয়া যায় নি। মেহেদী হাসান চলে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনো পূরণ হবার মত না। মেহেদী ভাইয়ের মত আর কোনো দেশের সম্পদ যাতে ভুল চিকিৎসায় মারা না যান।"
অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোনো আইনি লড়াইয়ে যেতে চান কিনা জানতে চাইলে কামরুল হাসান জানান, "আমার ভাইকে হারিয়ে ফেলেছি। তাকে আর ফিরে পাবো না। মামলা করলে ময়নাতদন্ত করা হবে, শরীরের কাটাছেঁড়া হবে। এমনিতেই তীব্র ব্যথা সয়ে আমার ভাই মৃত্যুবরণ করেছেন। আমার পরিবারের সদস্যরা চান না ভাইয়ের শরীরে আরো কষ্ট দিতে। এজন্য আমরা কোনো আইনি লড়াইয়ে যাবো না।"
এদিকে, অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা: আবু বকর ছিদ্দিক ফয়সালের সঙ্গে কথা বলার জন্য বুয়েট সাংবাদিক সমিতির পক্ষ থেকে একাধিক বার চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায় নি।
এই ঘটনায় গোমতী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা: মুজিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করেন প্রতিবেদক। তিনি বলেন, " আমার এই প্রাইভেট হাসপাতালে রোগীরা দুইভাবে চিকিৎসা পান । প্রথম ক্ষেত্রে, কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে আসলে রোগীর সাথে কথা বলে আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই তাদের সংশ্লিষ্ট কনসালটেন্ট এর কাছে পাঠিয়ে দিই। এসব ক্ষেত্রে রোগীর সম্পূর্ন দায়িত্ব থাকে আমাদের উপর। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, রোগীরা নিজেই কনসালটেন্ট বেছে নিয়ে পার্সোনালি তার দ্বারা ট্রিটমেন্ট করান। মেহেদী হাসানের বেলায় দ্বিতীয়টি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে, কনসালটেন্ট এর চিকিৎসা ও সেই চিকিৎসায় কোনো ভুল থাকলে তার দায় হাসপাতাল বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নেবে না। এছাড়া, আমার হাসপাতালের কোনো ব্যবস্থাপনা বা কোনো স্টাফ/ নার্স সম্পর্কে কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসে নি। তাছাড়া রোগী আমার হাসপাতালে মারা যায় নি। অন্য হাসপাতালে চিকিৎসায় কিছু হয়েছে কি না আমার জানা নেই।"
এদিকে, গোমতী হাসপাতালের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, এই ঘটনার তদন্তে কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের রিপোর্ট হাতে আসলে অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা যাবে।
এখনো কোনো মন্তব্য যুক্ত হয়নি!